দাদীমা, তুমি নিশ্চিত যে সকলে তোমার নির্দেশ অনুযায়ী আচরণ করবে?
হ্যাঁ। যেমনটা আমি নিশ্চিত তোমার ব্যাপারে। আর দেরি করা যাবে না, তুমি তৈরি থাকো। আমাকে জালির পিছনে আমার নিজের অবস্থানে যেতে হবে। সেলিমকে একটি চূড়ান্ত নিশ্চয়তার হাসি প্রদান করে এবং তার কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে হামিদা কক্ষ ত্যাগ করলো। শিঙ্গা বেজে উঠার আগে আয়ানায় নিজের চেহারাটি একবার দেখে নেয়ার জন্য এবং রেশমের কোমরবন্ধনীটির বাঁধন ঠিকঠাক করার জন্য সেলিম সামান্য সময় পেলো। ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে, সে উঁচু দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, দুজন দ্বাররক্ষী যার কপাট গুলি তার সম্মুখে মেলে ধরল। দরবার কক্ষে প্রবেশ করে সেলিম দেখতে পেলো তার বাবা সেই উঁচু পিঠ ওয়ালা সোনায়োড়া সিংহাসনটিতে বসে আছেন এবং তাঁকে ঘিরে তার সভাসদগণ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পরনে টকটকে লাল বর্ণের সোনা রূপার কারুকার্যখচিত রেশমি পোশাক, কোমরে সাদা কোমরবন্ধনী এবং মথায় আনুষ্ঠানিক সাদা পাগড়ি যাতে চারটি বড় আকারের পদ্মরাগমণির সাহায্যে দুটি ময়ূরের পালক আটকান। সেলিমের পিতামহের তলোয়ার আলমগীর তার পাশে। সেলিম আরেকটু কাছে এগিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলো তার বাবা তাঁদের পূর্বপুরুষ তৈমুরের দন্তবিদির্ণ বাঘের মাথা বিশিষ্ট আংটি পড়ে আছেন। যখন সেলিম তার বাবার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মানসূচক কুর্ণিশ করতে গেলো, হঠাৎ আকবর সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সেলিমকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এলেন। কয়েক মুহূর্ত তাকে ধরে থাকার পর তাকে ছেড়ে দিয়ে আকবর উপস্থিত সভাসদদের দিকে ফিরলেন।
আমি তোমাদের এই সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এটা প্রত্যক্ষ করার জন্য যে আমার সঙ্গে আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। অতীতে আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সকল মতভেদ বিস্মৃত হয়েছে। সকলে প্রত্যক্ষ করো, আমি আমার আনুষ্ঠানিক পাগড়িটি আমার পুত্রের মাথায় পড়িয়ে দিচ্ছি। আমাদের পুনর্মিলনের স্মারক স্বরূপ। আজ থেকে যে কেউ আমাদের যে কোনো একজনের বিরুদ্ধাচারণ করবে আমরা উভয়েই তাকে শত্রু বলে বিবেচনা করবো। কথা বলতে বলতে আকবর নিজের মাথা থেকে পাগড়িটি খুলে সেলিমের মাথায় পড়িয়ে দিলেন।
সেলিমের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি সর্বদা আমি আপনাকে সম্মান করবো এবং আজ থেকে আপনার প্রতিটি আদেশ আমার শিরোধার্য হবে।
যাইহোক, পনেরো মিনিট পর সেলিম যখন দরবার কক্ষ ত্যাগ করছিলো তখন তার মাঝে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলো। বাবার তাকে জড়িয়ে ধরার বিষয়টি কি অন্তঃসারশূন্য অভিনয়ের চেয়ে বেশি কিছু? বাবার কণ্ঠে কি কোনো আন্তরিকতা ছিলো যখন তিনি তার অন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব সমূহ বর্ণনা করছিলেন। সেগুলির কোনোটিই তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নয়। তিনি কি সত্যিই এতো সহজে তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন?
.
২৮. পিতা এবং পুত্র
আরো জোরে খোসরু। তুমি ওকে পরাজিত করতে পারবে, আগ্রাদুর্গের সম্মুখে অবস্থিত কুচকাওয়াজের মাঠের পশে দাঁড়ানো সেলিম চিৎকার করে উঠলো। তার জ্যেষ্ঠপুত্র, ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন টাটুঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে শক্ত মাটিতে গাথা বর্শার মধ্য দিয়ে একে বেকে ছুটছে। সে শংকর ঘোড়ার পিঠে আসিন আরেকটি তরুণের ঠিক পেছনে রয়েছে যে তার বাম পাশে সমান্তরাল ভাবে গাথা আরেক সারি বর্শার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা দুজন তৃতীয় আরেকজন তরুণের তুলনায় এগিয়ে আছে যে খোসরুর ডান পাশে রয়েছে। তৃতীয় তরুণটি অবশ্য ইতোমধ্যে একজোড়া বর্শা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিজ ঘোড়াটিকে সেগুলির মধ্য দিয়ে পুনরায় চালিত করার চেষ্টা করছে। এক মিনিট পর সমাপ্তি লাইন অতিক্রম করার সময় খোসরু তার ঘোড়াটির ঘাড় কিছুটা সামনে অগ্রসর রাখতে সক্ষম হলো। ঘোড়াটির মাথা তখন নিচু হয়ে ছিলো এবং সেটার শ্বাস ফেলার ধাক্কায় ধূলো উড়ছিলো।
সেলিম যখন রাজধানী ছেড়ে এলাহাবাদ সহ অন্যান্য জায়গায় দুই বছর পার করেছে সেই সময়ের মধ্যে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি কতোই না বদলে গেছে। সে যখন রাজধানী ত্যাগ করে খোসরু তখনো বালক। কিন্তু বর্তমানে সে সতেরো বছর বয়সী একজন তরুণ। নিজ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় খোসরু বা পারভেজকে সঙ্গে নিতে না পারার জন্য তার এখন আফসোস হচ্ছে। ছোট্ট খুররমকে সাথে নেয়া আরো বেশি কঠিন হতো যে এখন তেরো বছরে পদার্পণ করেছে। জন্মের পর থেকে অধিকাংশ দিনই সে তার দাদার সংগে কাটিয়েছে এবং সাধারণত রাত্রে দাদার কক্ষেই ঘুমাতো। এমনকি এখনোও তারা দুজন দশ গজ দূরে একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়েই খোসরুকে লক্ষ্য করে জোরালো হাততালি প্রদান করছে যে ঘোড়া থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে আকবরের দিকে এগিয়ে আসছে। আকবরের হাতে একটি রত্নখচিত হাতল বিশিষ্ট অশ্বচালনার চাবুক দেখা যাচ্ছে যেটা তাঁর জ্যেষ্ঠ নাতির বিজয়ের পুরষ্কার।
দৃশ্যটি পারিবারিক সম্প্রীতির কততইনা মনোহর চিত্র, সেলিম ভাবলো। সে অনেক দীর্ঘ সময় গোটা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। দ্রুত হেঁটে সেলিম তার বাবার কাছে পৌঁছালো, তখন আকবরের বাড়িয়ে ধরা হাত থেকে খোসরু তার পুরস্কার গ্রহণ করছে। খুব ভালো খেলা দেখিয়েছো খোসরু। আমি তোমার বয়সে ঘোড়া চালনায় যতোটা পারদর্শী ছিলাম তুমিও সেই দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। আমি প্রার্থনা করি তোমার এই দক্ষতা বজায় থাকুক এবং তোমার অর্জিত অন্যান্য সূক্ষ গুণাবলী গুলিও, যে বিষয়ে তোমার শিক্ষকগণ আমাকে অবহিত করেছে। কোনো দুর্বলতা সৃষ্টিকারী নেশা, বদঅভ্যাস বা লালসার প্রভাবে তোমার গুণগুলি নষ্ট হতে দিও না, আমাদের পরিবারের কিছু সদস্য যেমনটা করেছে, আকবর বললেন।