আমি জানি তার সেনাবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত কিন্তু এখনোও পর্যন্ত তিনি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেননি। তিনি আমার বিদ্রোহকে উপক্ষো করেছেন এবং আমাকে একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যে কেউ আমার সঙ্গে যোগ দেবে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকিও প্রদান করেননি। এর পরিবর্তে তিনি তার প্রধান সেনাবাহিনীকে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করেছেন। আমি মনে করি না এখন তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে আমার উপর আক্রমণ চালানে।
কেনো? আবুল ফজল তো একাধারে তাঁর বন্ধু এবং উপদেষ্টা ছিলো।
কিন্তু আমি তাঁর আপন পুত্র। তিনি জানেন তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে। এক বছর আগে মুরাদের মৃত্যু হয়েছে এবং তার নাতিদের বয়স এখনোও অনেক কম। তিনি অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে উত্তরাধিকারী হিসেবে মাতাল দানিয়েল অথবা। আমি এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। আমার ব্যাপারে তাঁর মনে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু এর কোনো বিকল্প উপায়ও তার সামনে নেই। তাছাড়া আবুল ফজলকে হত্যা করে আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে আমি আমার অপ্রশমণযোগ্য শত্রুকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে পারি যেভাবে বাবা নিজে হিমু, আদম খান এবং অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের দমন করেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি আর আমাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। এই মুহূর্তে তিনি তার সেনাবাহিনীকে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে আমার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিবর্তে আমার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করবেন।
আমাদের সকলের স্বার্থেই আমি প্রার্থনা করছি সম্রাটের মানসিকতা সম্পর্কে তোমার অনুমান সঠিক হোক।
*
সেলিম খবর পেলো তার পিতামহীর কাফেলা এলাহাবাদ থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে রয়েছে। সে ব্যাপক উৎকণ্ঠা নিয়ে হামিদার পৌঁছানোর অপেক্ষা করছে। কয়েক ঘন্টার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুমের পর, ভোর থেকে সে তার কক্ষে পায়চারী করছে। উত্তেজনা দমন করার জন্য ওপিয়াম বা সুরা পান করা থেকেও অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রেখেছে। রাজধানী ত্যাগ করার পর দীর্ঘদিন সে দাদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বঞ্চিত রয়েছে। নিজের স্ত্রী বা নিজ মায়ের তুলনায় হামিদার প্রতি সে অনেক বেশি ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু তিনি কি বুঝতে পারবেন কেনো সে তার বাবার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করেছে? তিনি কি তাঁর নিজের উদ্যোগেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন নাকি বাবা তাকে পাঠিয়েছেন? এটা নিশ্চিত যে তিনি বাবার কাছ থেকে কোনো বার্তা বয়ে আনবেন, কিন্তু সেটা কি হবে? আবুল ফজলের মৃত্যুর বিষয়ে বাবার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে ব্যাপারে সে যথেষ্ট অনিশ্চিত যদিও সুলায়মান বেগের কাছে অন্যরকম মনোভাব প্রকাশ করেছে। তবে শীঘই সব কিছু তার কাছে পরিষ্কার হবে। সেলিম দুর্গের সম্মুখের রৌদ্রজ্জ্বল উঠানে টাঙ্গানো সবুজ চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো। সমগ্র উঠানে সেলিমের নির্দেশে গোলাপের পাপড়ি ছিটানো হয়েছে। অল্প সময় পরে হামিদার কাফেলার অগ্রবর্তী ঘোড়সওয়ারদের দুর্গের প্রবেশ দ্বারে উপস্থিত হতে দেখা গেলো। তারপর শিঙ্গার আর্তনাদ এবং ঢাকের গুরুগম্ভীর বাজনার সঙ্গে হামিদাকে বহনকারী বিশাল আকৃতির হাতিটি ধীরে দুর্গ চত্বরে প্রবেশ করলো। সোনার কারুকাজ এবং রত্নখচিত হাওদাটি ঘিয়া বর্ণের পাতলা পর্দা দিয়ে আড়াল করা হয়েছে রোদ এবং লোকচক্ষুর কাছ থেকে আরোহীদের আচ্ছাদিত রাখার জন্য।
যেই মাত্র মাহুত হাতিটিকে হাঁটার উপর বসালো তখনই সেলিম সকল পুরুষ পরিচারক এবং রক্ষীদের ঐ স্থান ত্যাগ করতে আদেশ দিলো। সেলিম হাওদার পাশে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চটির উপর উঠে পর্দা সরালো। হাওদার ভিতরের অল্প আলো তার চোখে সয়ে আসতেই সে তার দাদীর পরিচিত অবয়বটি দেখতে পেলো। তাঁর বিপরীত দিকে বসে আছে জোবায়দা যাকে সেলিম কাশ্মীরের পাহাড়ি খাদ থকে উদ্ধার করেছিলো। সেলিম ঝুঁকে হামিদার কপালে চুমু খেলো। এলাহাবাদে আমার দুর্গে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি দাদীমা, সেলিম বলে উঠলো এবং অনুভব করলো কেমন কৃত্রিম, বিব্রতকর এবং অনুষ্ঠানিক শোনলো তার কণ্ঠস্বর।
আমি এখানে আসতে পেরে আনন্দিত। তুমি তোমার উপযুক্ত স্থান এবং পরিবারের কাছ থেকে বহু দিন ধরে দূরে রয়েছে। তারপর সেলিমের আড়ষ্ট মুখভাব লক্ষ্য করে হামিদা বললেন, আমরা সে বিষয়ে পরে কথা বলবো, এখন আমাকে এবং জোবায়দাকে হাওদা থেকে নামতে সাহায্য করো।
সেইদিন সূর্যাস্তের সময় সেলিম দুর্গের মহিলাদের আবাসস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো যেখানে সবচেয়ে উত্তম কক্ষের একটিতে তার দাদীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা দুর্গের সবচেয়ে উঁচুতলার কক্ষ যেখান থেকে গঙ্গা নদী নজরে পড়ে। মহিলা কক্ষের দিকে প্রসারিত্ব শীতল আধার সিঁড়িধাপের কাছে পৌঁছে সেলিম তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। দাদীকে আবার দেখার জন্য এবং তার বয়ে আনা বর্তা শ্রবণ করার জন্য সে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে। কক্ষের রেশমী পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে দেখতে পেলো হামিদা জাঁকজমকহীন কিন্তু পরিপাটি বেগুনি বর্ণের পোশাক পড়ে একটি নিচু চেয়ারে বসে আছেন এবং জোবায়দা তার চুলের গোছা ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। সেলিমকে দেখে তিনি জোবায়দাকে প্রস্থান করতে বললেন।