নিমেষ পরেই, হুমায়ুন তাবুগুলোর কোনো একটার চাঁদোয়ার নীচে থেকে মাস্কেটের কর্কশ শব্দ ভেসে আসতে শুনে- সিকান্দার শাহর অন্তত কিছু লোক নিজেদের বারুদ শুকনো রেখেছে। সে তার চোখের কোণে দেখতে পায় মুস্তাফা আগুনের একজন তূর্কী সৈন্য কপালের পাশে বুলেটের একটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনো শব্দ না করে নিরবে পর্যান থেকে পিছলে যায়। তাঁর আতঙ্কিত ঘোড়াটা হুমায়ুনের ঘোড়ার গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়। হুমায়ুন দ্রুত নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেও আতঙ্কিত জন্তুটা পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হুমায়ুনের তাঁর দক্ষতার পুরোটা দরকার হয় নিজেকে তাঁর বাহনের পিঠে অধিষ্ঠিত রাখতে, যখন তাঁর ঘোড়াটা পুনরায় চারপা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে, একপাশে পিছলে গিয়ে অন্য অশ্বারোহীদের অগ্রগতি রুদ্ধ করলে। হুমায়ুনের বেকায়দা অবস্থা দেখে তারাও সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজেরাই পালাক্রমে লাগাম টেনে ধরতে শুরু করে, নিজেদের সিকান্দার শাহের লোকদের কাছে একটা লোভনীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মাস্কেটের সাদা ধধায়ায় আচ্ছাদিত একটা তাবু থেকে এক ঝাঁক তীর শূন্যে ভাসে। হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন লোক আহত হয়। একজন হাতের তরবারি ফেলে দিয়ে কাদায় সটান আছড়ে পড়ে সেখানেই স্থির হয়ে থাকে। অন্যেরা ঘোড়ায় টিকে থাকলেও ক্ষতস্থান পরিচর্যায় সহযোদ্ধাদের কাতার থেকে পিছিয়ে পড়ে।
হুমায়ুনের সৈন্যসারির পার্শ্বদেশ থেকে প্রায় একই সাথে দুটো বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। সে শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে যে সিকান্দার শাহের তোপচিরা তাঁদের দুটো বিশাল কামানকে কর্মক্ষম করে তুলেছে, যেখান থেকে তারা কাঠের রুক্ষ তক্তার ছাদের নীচে অবস্থান করে বৃষ্টির ছাট থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় নিজেদের কাজ শুরু করেছে। কামানের দুটো গোলাই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। একটা গোলা একটা কালো ঘোড়ার উদরে আঘাত করে সেটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। জন্তুটা উন্মুক্ত ক্ষতস্থান থেকে নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসা অবস্থায় টলমল করে চেষ্টা করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু তারপরে কাদায় পিছলে গিয়ে করুণস্বরে চিহি শব্দ করতে থাকে। দ্বিতীয় কামানের গোলা আরেকটা ঘোড়ার সামনের পা উড়িয়ে নিয়ে গেলে তাগড়া জন্তুটা কুকড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং পিঠের আরোহীকে মুস্তাফা আগুনের আরেকজন যোদ্ধাকে নিজের মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে।
পুরো ব্যাপারটাই খুব দ্রুত সংঘটিত হয় এবং হুমায়ুন তাঁর নৃত্যরত ঘোড়ার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার মাঝে সহসা একটা চিন্তা তাঁকে একেবারে জমিয়ে দেয়। সে হয়ত সযত্নে রচিত একটা ফাঁদে এসে নিজে ধরা দিয়েছে। সিকান্দার শাহর লোকেরা হয়ত ঘুরে এসে তাদের পিছনের রাস্তা এতক্ষণে আটকে দিয়েছে। তার নাগাল থেকে হিন্দুস্তানের সিংহাসন নিশ্চয়ই আরো একবার কেড়ে নেওয়া হবে না? না, এটা হতে পারে না… তার নিয়তি নির্ধারিতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বিচ্যুত হবে, এই ক্ষণিকের বিশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণের পথে সন্দেহ কোনমতেই বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।
দলবদ্ধ হও, জড়ো হও সবাই! আমাদের কোনমতেই আক্রমণের বেগ শ্লথ করা চলবে না, সে চিৎকার করে বলে। গাদাবন্দুকধারীরা যে তাবু থেকে গুলি বর্ষণ করছে সে তাঁর হাতের আলমগীর আন্দোলিত করে সরাসরি সেদিকে ঘোড়ার মুখ ঘোরায় এবং পুরু, পিচ্ছিল কাদার উপর দিয়ে যত দ্রুত ছোটা যায় সেজন্য প্রাণীটার পাঁচরে গুঁতো দেয়। তার দেহরক্ষীরা সাথে সাথে তাকে অনুসরণ শুরু করে। আরো কয়েকবার গাদাবন্দুকের আওয়াজ শোনা যায় এবং আরেকজন যোদ্ধা ভূপাতিত হয় কিন্তু তারপরেই হুমায়ুন শত্রু তবকিদের মাঝে গিয়ে হাজির হতে তারা তখন নিজের লম্বা নলের অস্ত্র আর সেটা ধারণকারী তেপায়া একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে পালাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠে। হুমায়ুন আলমগীরের এককোপে একজনকে ধরাশায়ী করে কিন্তু তারপরেই সে আর তাঁর দেহরক্ষীরা শত্রুপক্ষের একদল অশ্বারোহীদের আক্রমণের মুখে পড়ে, যাদের তারা আগেই অশ্বারূঢ় হতে দেখেছিল। শক্তপোক্ত দেখতে একজন সেনাপতি বাদামী রঙের একটা ঘোড়ায় চেপে জল্লুটার মুখে হীরক দীপ্তি সরাসরি হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসে, তাঁর বামহাতে ধরা বর্শার ফলা সরাসরি হুমায়ুনের বুক লক্ষ্য করে স্থির রয়েছে।
হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখটা মোচড় দিয়ে সরিয়ে নেয় এবং বর্শার ফলাটা তাঁর বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে আঘাত করে পিছলে গেলে সে নিজেও খানিকটা ভারসাম্য হারায়, ফলে তাঁর তরবারির ফলাও নিশানায় আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। উভয়েই নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টানটান করে টেনে ধরে রেখে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে এবং শত্রুপক্ষের লোকটা এবার বর্শা ফেলে দিয়ে নিজের কোমর থেকে তরবারি বের করে তার দিকে এগিয়ে আসে। হুমায়ুন মাথা নীচু করে তার তরবারির বৃত্তাকার গতি এড়িয়ে যায়, তরবারির ফলা তার মাথার উপর দিয়ে বাতাস কেটে নিষ্ফল ভঙ্গিতে বের হয়ে যেতে একটা হুশ শব্দ সে শুনতে পায়। সে এবার আলমগীর নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের বক্ষস্থল লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা শিকলের বক্ষাবরণী দ্বারা আবৃত নেই। তরবারির ক্ষুরধার ফলা অনায়াসে নরম, চর্বিযুক্ত পেশীর গভীরে কেটে বসে যায় এবং শত্রুপক্ষের সেনাপতি তার বাদামী ঘোড়ার গলার উপরে নুয়ে পড়ে, ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্তপাত হচ্ছে, যা তাকে পিঠে নিয়ে ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে যায়।