সোয়া এক ঘন্টা পরে সব কাজ শেষ হয়। হুমায়ুন তাঁর বেশীর ভাগ লোককে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেয় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ তদারকি করতে নিজে কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে পেছনে থেকে যায়। বারুদে অগ্নি সংযোগের সম্মান সে দীর্ঘদেহী এক তরুণ বাদশানীর উপরে অর্পণ করে বেচারা চকমকি পাথরের বাক্স নিয়ে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে স্ফুলিঙ্গ তৈরীর জন্য কসরত করতে থাকে। সে শেষপর্যন্ত যখন সফল হয়, বারুদের জ্বলন্ত শিখা মাটির উপর দিয়ে ক্রমান্বয়ে থুতু ফেলার মতো একটা শব্দের জন্ম দিয়ে এগিয়ে যায়। একটা ছোট পাথরের সাথে প্রান্ত ঘেঁষে যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় শিখাটা বুঝি নিভে যাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটা আবার সামনে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। প্রায় সাথে সাথে এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে আরও পাঁচটা বিস্ফোরণের শব্দ এর পরপরই শোনা যায়। প্রতিটা কামানের নলের ভিতরে বারুদের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
ধূলো আর উৎক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষের টুকরো থিতিয়ে আসতে হুমায়ুন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে তখনও কানে তালা লেগে রয়েছে, দেখতে পায় যে চারটা নল লম্বালম্বিভাবে ফেটে গিয়ে পেছনের দিকে বেঁকে এসেছে ঠিক অনেকটা কলার খোসা ছাড়াবার মতো। আরেকটা আক্ষরিক অর্থেই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ষষ্ঠ কামানের নলে কেবল ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে- হুমায়ুন ভাবে, কামানটাকে অকেজো করতে এটাই যথেষ্ট। তাঁর লোকেরা এবার দ্রুত ফিরে আসে এবং অবশিষ্ট মালবাহী গাড়িগুলোতে মূল্যবান দ্রব্যের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কেউ একজন কিছু রেশমের কাপড় খুঁজে পায়, অন্য আরেকজন একটা সিন্দুকের তালার ভিতরে তাঁর খঞ্জরের অগ্রভাগ প্রবিষ্ট করিয়ে সিন্দুকটা জোরপূর্বক খুলতে চায় ভেতরে মূল্যবান কোনো পাথর আছে কিনা দেখতে।
হুমায়ুন এর ভেতরেই তার অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্যকে যাদের উপরে সে রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দিয়েছিল ঘোড়া দাবড়ে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে। সুলতান, গুজরাতিরা পুনরায় একত্রিত হয়েছে। আক্রমণের জন্য তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছে, আমরা সংখ্যায় কত অল্প সেটা এখন তাদের চোখে পড়েছে।
আমরা অবশ্যই ফিরে যাব। তূর্যবাদক পশ্চাদপসারণের-সঙ্কেত ধ্বনিত কর। আমরা পাহাড়ের ঢালের উপরে গিয়ে অবস্থান নেব। তারা আমাদের অনুসরণ করার মতো মূর্খতা দেখাবে না। তারা ভালো করেই জানে যে উপরে উঠার প্রয়াসরত অবস্থায় তারা যদি আমাদের আক্রমণের সুযোগ দেয় তবে তার মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু।
বিশ মিনিট পরে, বেলেপাথরের সেই ঢালের উপর থেকে নীচের দিকে সেনাসারির ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন গুজরাতিদের সেখানে জটলা করতে দেখে। কয়েকজন অতিলোভী নির্বোধ ছাড়া, যারা লুটের সম্ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে মালবাহী গাড়ির দ্রব্যসামগ্রী তল্লাশি করতে অনর্থক দেরী করেছিল, তার বাকি লোকেরা নিরাপদেই ফিরে এসেছে। তাদের ভিতরে, হুমায়ুন বিষণ্ণ মনে ভাবে, সেই তরুণ বাদশানীও রয়েছে, পাহাড়ী ঢালের উদ্দেশ্যে অনেক দেরীতে ঘোড়া ছোটালে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়ে বেচারা মাটিতে আছড়ে পড়েছে। তার পর্যাণের সাথে নকশি করা গোলাপি রেশমের চোঙের মতো গোল করে পাকানো রোলের পাক খুলে গিয়ে তার সওয়ারীবিহীন ঘোড়ার পেছনে অবাধে মাটিতে লুটাচ্ছে।
*
চোখের সামনে ওখানে রয়েছে- লম্বা তালগাছের সারি এবং কমলালেবুর ধুসর খোসার মতো বালির পরেই দীপ্তিময় সমুদ্রে মধ্যাহ্নের সূর্যের আলো এমন তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয় যে হুমায়ুন বাধ্য হয় হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আড়াল তৈরী করতে। শক্রর সৈন্যসারির উপরে সাফল্যের সাথে ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করার পরে হুমায়ুন তাঁর সাথের তিন হাজার সৈন্যের বহরের অর্ধেক সৈন্য তাঁর মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য পাঠিয়ে দেয়, যা এই মুহূর্তে অবরোধের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আর অনুষঙ্গ নিয়ে মোগল ভূখণ্ড থেকে চম্পনীর জঙ্গলবেষ্টিত দূর্গের অভিমুখে খুব ধীরে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
হুমায়ুন বাছাই করা দেড় হাজার অশ্বারোহীর একটা চৌকষ বাহিনী নিয়ে নিজে গুজরাতের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যেখানেই শত্রুসেনার কোনো বাহিনীকে খুঁজে পায় সেখানেই তাঁদের পরাস্ত আর বিপর্যস্ত করে তুলে। সে নিশ্চিত, তার মূল বাহিনী কোথায় আসল আঘাত হানবে সে বিষয়ে গুজরাতিদের বিভ্রান্ত আর অনিশ্চিত করে তুলতে সে সফল হয়েছে; ঠিক যেমন সে পরিকল্পনা করে এসেছিল। ঝটিকা আক্রমণের সময়ে ধৃত গুজরাতিদের মুখে সামরিক উপকরণ আর বাণিজ্যিক পণ্য বহনকারী একটা কাফেলা কাম্বের সমুদ্র বন্দরের অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে জানতে পেরে সেটার পশ্চাদ্ধাবন করে সে সমুদ্রের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। হুমায়ুন ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় যে সে কাফেলাটাকে খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। সে জওহরকে তার পাশে ডাকে। আমার আদেশ জানিয়ে দাও যে মধ্যাহ্নের খরতাপে আমরা তালগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেব আর নিজেদের সতেজ করে নেব আর সেই সময়ে আমাদের অনুসন্ধানী দূত কাফেলাটার খোঁজ করবে। সেটার এখন আর খুব একটা বেশী দূরে অবস্থান করার কথা না। বস্তুতপক্ষে, আমরা যা জানতে পেরেছি সেটা সত্যি হলে কাম্বে বন্দরের দূরত্ব এখান থেকে দশ মাইলের বেশী হবার কথা না, সমুদ্রের উপকূলের উত্তরপশ্চিমে কোথায় সেটা রয়েছে। প্রহরী আর প্রতিহারী মোতায়েনেরও আদেশ জানিয়ে দাও যাতে করে কেউ আমাদের যেন চমকে দিতে না পারে।