মাথা নাড়ল সাদিক বেগ। হ্যাঁ অপেক্ষা করুক আমাদের শত্রুরা…ঘেমে নেয়ে উঠুক। গোলকুত্তা আর বিজাপুরের শাসকেরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার অনুশীলন করুক। একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ক যে কে যাবে সবার সামনে, অভিযানে কার তাঁবুতে গর্ব ঝরে পড়বে।
*
নিজের আসনে বসে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকালেন শাহজাহান। দিগন্তের কাছে ঝুলে আছে ভারী ধুলার পর্দা। এর মাঝে দিয়ে দেখা যাচ্ছে সৈন্যদের লম্বা-চওড়া মাথার বর্শা। পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে অসংখ্য মানুষ আর প্রাণীর পদভারে। পুরো সারি থেকে ভেসে আসছে বাদক দলের তালে তালে বাজনার শব্দ। এর মাধ্যমে সৈন্যবাহিনী নিজেদের চলার গতি সুশৃঙ্খল রাখে। তার কর্মচারীরা প্রতিদিনের যাত্রাপথের হিসাব রাখে গিঁট বাঁধা দড়ির মাধ্যমে, এরপর সন্ধ্যা বেলা জানানো হয় ম্রাটকে। ষষ্ঠ সপ্তাহ পরে উজ্জয়নী শহরের দিকে অগ্রসর হল পুরোদল। বোরহানপুরের পথে দুই-তৃতীয়াংশ রাস্তা শেষ হয়েছে। আগামীকাল মমতাজের জন্মদিন। মনে মনে এ আনন্দ উদযাপনের জন্য সমস্ত পরিকল্পনা আবারো ভেবে দেখলেন শাহজাহান। সব কিছুই হতে হবে একেবারে নির্ভুল…।
হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। ডানদিকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে একজন একাকী ঘোড়সওয়ার। সাথে সাথে দেহরক্ষীরা সম্রাটের হাতির চারপাশে নিজেদের জায়গা মত দাঁড়িয়ে গেল। হাতে উদ্যত তলোয়ার। কিন্তু ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসতেই শাহজাহান চিনতে পারলেন ঈগলের মত নাক বিশিষ্ট তার দূতদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একজনকে–একজন তরুণ রাজপুত। রায় সিং। হাত নেড়ে নিজের প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন যেন তরুণকে এগিয়ে আসতে দেয়া হয়। ঘোড়া থেকে নেমে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়াল রায় সিং।
কী হয়েছে? কথা বলো!
জরুরি সংবাদ, জাহাপনা। চম্বল নদীর উপর নৌকা আর কাঠ দিয়ে আমাদের বানানো সেতু ভেঙে পড়েছে প্রথম কামান আর রসদবাহী গাড়ি পার করার সময়। আমাদের কয়েকজন লোক ডুবে গেছে। এছাড়া দুটো কামান আর এগুলোর সঁড়ের দলও হারিয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই সেতু নির্মাণে ত্রুটি ছিল। কে ছিল এর দায়িত্বে?
সুলাইমান খান। কিন্তু জাহাপনা, তিনি বলেছেন সেতু নির্মাণে কোন ত্রুটি হয়নি। তিনি বিশ্বাস করেন যে নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে সেতুর দড়ি কেটে দিয়েছে। তাই আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আপনাকে জানাই।
সরষের মাঝে ভূত? যদি তাই হয় তাহলে এটাই প্রথম নয়, ভাবলেন শাহজাহান। দুই সপ্তাহ আগে কেউ একজন প্রাণীদের খোয়াড়ে ঢুকে হত্যা করেছে কয়েকটা গাভীকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একেবারে মৃত্যুর আগমুহূর্ত ধরা পড়েছে অসহায় জন্তুগুলো। তাই আর কোন উপায় ছিল, মেরে ফেলতে হয়েছে অবোধ পশুগুলোকে। এই ক্ষেত্রে যদিও তিনি কোন স্থানীয় চোরকে দায়ী করেছেন; কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে শত্রুপক্ষ উত্তরে লোক পাঠিয়েছে সেনাবাহিনীর গতিরোধ করতে। আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। আদেশ দিলেন শাহজাহান।
দশ মিনিট পরে শাহজাহান রায় সিংয়ের পাশে ঘোড়া ছুটালেন চম্বল নদীর উদ্দেশে। নদীর উত্তর তীরে বালিয়াড়ীর কাছে পৌঁছাতেই দেখতে পেলেন উড়ে গেল একজোড়া বক পাখি, তপ্ত নীলাকাশে দেখা যাচ্ছে ওগুলোর পাতলা, সরু পা। মনোযোগ দিলেন নিচে, নদীর দিকে। সৈন্যরা দ্রুত বহমান সবুজ পানিতে কাঠের দঙ্গলের সাথে যুদ্ধ করছে, চেষ্টা করছে নৌকাগুলো থেকে রসদ আর যন্ত্রপাতি উদ্ধার করতে যেন ক্ষয়-ক্ষতি আর না হয় সেতুটির। কয়েকটা নৌকা স্রোতের টানে নিচের দিকে ভেসে চলেছে, আরেকটু হলেই গাঢ় আর থকথকে আবর্জনার ভিড়ে হারিয়ে যাবে। তাকাতেই দেখতে পেলেন দুজন সৈন্য মিলে পিচ্ছিল নদী তীরে টেনে আনছে এক সহযোদ্ধাকে। লোকটার চেহারায় ফুঠে উঠেছে। স্পষ্ট যন্ত্রণা, রক্তমাখা হাত একেবারে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অন্য আরো দুজন কাঠ দিয়ে তৈরি স্ট্রেচার বহন করে আনছে নদী তীরে। এর উপরে শুয়ে থাকা দেহটার হাত ঝুলছে পাশে। এর বেশ খানিকটা দূরে নদী তীরে দেখা গেল মৃতদেহের স্তূপ। কোনমতে ঢেকে রাখা তুলার কম্বলের নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে এলোমলো পা।
সুলাইমান খানকে এখনি পাঠাও আমার কাছে। রায় সিংকে বলে উঠলেন শাহজাহান, নিজে ঘোড়র গায়ে লাথি দিয়ে নদীর ঢালু তীরে নেমে গেল রায় সিং। অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে তাকিয়ে ধ্বংসের পরিমাণ জরিপ করে দেখলেন সম্রাট। নৌকা-সেতুর অর্ধেকেরও বেশি অংশ নদীর মাঝ বরাবার থেকে একটু দূরে সরে গেলেও এখনো অক্ষত আছে। কিন্তু অবশিষ্ট অংশ একেবারে ভেঙে গেছে, শুধুমাত্র তিনটা অথবা চারটা কাঠের খুঁটি, যা নৌকাগুলোকে আটকে রেখেছিল, কোনমতে টিকে আছে। কামানের লম্বা ব্যারেল দেখা যাচ্ছে পানির উপরে আর পাশেই ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা একটা ষাঁড়ের মৃতদেহ, এখনো বাধা অস্ত্রের গাড়ির সাথে। পানির কিনারে মৃত আরো দুটো পশুর দেহ দেখা গেল। এই ধরনের হীন কাজ কী কেউ সত্যিই ইচ্ছেকৃতভাবে করেছে তার গতি থামিয়ে সৈন্যদেরকে বিপদে ফেলতে, নাকি এটা নিছক দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই ফল? নিশ্চিত হতে পারলেন না যে কোনটি বেশি দুশ্চিন্তার।
ক্রোধ আর হতাশায় ছেয়ে গেল তাঁর মন, দেখলেন বালিয়াড়ী বেয়ে অনেক কষ্ট করে এগিয়ে আসছে সুলাইমান খান শক্তিশালী এক পুরুষ-ঘামে ভিজে গেছে পরনের পোশাক।