রত্নকারেরা ও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। জমকালো তক্ত-ই-তাউস, ময়ূর সিংহাসন নির্মাণের কাজে। ঠিক যেমন সিংহাসনে বসে এক সময় ন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন মহান বাদশাহ সোলেমান। এ উদ্দেশ্যে দুই হাজার পাউন্ড বিশুদ্ধ স্বর্ণ বরাদ্দের পাশাপাশি শাহজাহান নিজে আগ্রা রাজকোষ থেকে পছন্দ করে দিয়েছেন অনিন্দ্য সুন্দর সব রত্ন পাথর। এগুলোর উজ্জ্বল আভাতে প্রায় প্রচণ্ড দেহ সুখের অনুভূতি অনুভব করেছেন তিনি। নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন যে অভিযান সফল হবেই। আর তাহলে গোলকুণ্ডার খনি থেকে তাজা হীরের যোগান নিয়ে ফিরবেন তিনি। রত্নপাথরের মাঝে হীরের প্রাচুর্যই বেশি একমাত্র গোলকুণ্ডাতে। এ ছাড়াও তিনি ভেবে রেখেছেন–কয়েকটি হীরে বসিয়ে দেবেন সিংহাসনের আসনে ওঠার সিঁড়ি তিনটিতে। আর তাহলেই যতবার তিনি সিংহাসনে আরোহণ করবেন শত্রু ততবারই পদানত হবে।
প্রস্থানরত সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে অভিবাদনের উদ্দেশ্যে আরো একবার তলোয়ার উঠিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এলেন শাহজাহান। মমতাজের কাছে যেতে হবে। হারেমের আঙিনাতে পৌঁছে দেখতে পান স্বর্ণমণ্ডিত ও পর্দাঘেরা শিবিকা আর এটি বহনকারী আটজন নপুংসকও প্রস্তুত। কিছুক্ষণ পরে মমতাজ নিজে এসে হাজির হন। সাথে আসে পনের বছর বয়সী জাহানারা আর বারো বছর বয়সী রোশনারা।
আমি খুশি হয়েছি যে তুমি শিবিকা ব্যবহারে একমত হয়েছে– তোমার এই অবস্থায় হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণ নিরাপদ নয়।
আপনার পরামর্শ আমি খুব কমই প্রত্যাখ্যান করেছি।
আরেকটা কথা। এই মুহূর্তে এটাই ভালো হবে যে তুমি আর হারেমের দলবল ভিন্ন একটি পথ দিয়ে যাবে, যেন প্রধান সারির সৃষ্ট ধুলায় সমস্যা না হয়। আমি খোঁজাদের আদেশ দিয়েছি যেন তোমার শিবিকার পাশে হেঁটে ময়ূর পাখনা দিয়ে বাতাস করে আর অন্যরা সামনের রাস্তায় গোলাপ পানি ছিটিয়ে দেবে। তোমার নিরাপত্তাও অটুট থাকবে। আমার রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনীর পাঁচশ জন শ্রেষ্ঠ সৈন্য এ দায়িত্ব পালন করবে।
আপনি আমাকে নিয়ে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন থাকেন।
কারণ আমি জানি, আমাদের সামনে দীর্ঘ আর কঠিন একটি ভ্রমণ আসছে।
আমি নিজেই এটি নির্বাচন করেছি। আপনি যতটা ভাবছেন আমি তার চেয়েও শক্ত। আগেও এর প্রমাণ পেয়েছেন আপনি। অন্তত প্রতিটি দিনের ভ্রমণ শেষে আপনাকে মুবারক মঞ্জিল স্বাগতম জানাতে পারব আমি।
*
আমার মনে হয় আমাদের আরো দ্রুত এগোনো উচিত–যতদিন যাচ্ছে শত্রুকে তার অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ দিচ্ছি আমরা। মালিক আলীর লম্বাটে চেহারা একাগ্রতা ফুঠে উঠল। এরকম অঞ্চলে আমরা সহজেই অন্তত পাঁচ…এমনকি দশ মাইলও পার হতে পারি একদিনে।
কিন্তু কেন? চর মারফত আজ সকালে জানতে পেরেছি যে, জাকির আবাস সফলতার সাথে আমাদের বাহিনীকে বোরহানপুরে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, ক্ষত-ক্ষতির পরিমাণ যতটা আশংকা করেছিলাম ততটা হয়নি। কোন না কোন কারণে বিজাপুর আর গলকোণ্ডার বাহিনী আমাদের সৈন্যদের তেমন একটা লুট বা ধ্বংস করেনি। নিজের যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের উপর চোখ বোলালেন শাহজাহান। অর্ধ-চন্দ্রকারে ম্রাটকে ঘিরে চাঁদোয়ার মত তাঁবুর নিচে বসে আছে সকলে।
কেন তারা তাদের সুযোগের সদ্বব্যবহার করেনি? আমার মনে হয় এক্ষেত্রে কোন কৌশল বা ষড়যন্ত্র আছে। বলে উঠল সাদিক বেগ, বেলুচিস্তানের পর্বত থেকে আগত ধূসর দাড়িওয়ালা সেনাপ্রধান। কথা বলতে বলতে সামনে রাখা পিতলের থালা থেকে তুলে নিল মুঠো ভর্তি আমন্ড বাদাম, তৃপ্তি ভরে চিবোতে লাগল।
চওড়া কাঁধ নেড়ে শ্রাগ করে উঠলেন শাহজাহান। বলা কঠিন যে এ জাতীয় কোন চিন্তা আছে নাকি তাদের মাথায়। হতে পারে নিজেদের সফলতা দেখে আমাদের মতই বিস্মিত হয়ে গেছে তারা। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তর্কে মেতেছে। বিজাপুর আর গোলকুন্ডা প্রতিবেশী হিসেবে কখনোই ভালো ছিল না। আমাদের প্রতি তাদের যে হিংসা আর ঘৃণার মনোভাব, পরস্পরের বিরুদ্ধেও তাই। কিন্তু আরো কিছু সংবাদ আছে…মনে হচ্ছে এই আক্রমণ আমাদের দক্ষিণ সীমান্তের একটি বা দুটি প্রজা রাষ্ট্রকে উসকে দিয়েছে নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য। মাভুতে আমার প্রাদেশিক শাসকেরা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে যে মীরাপুর প্রদেশে স্থানীয় রাজা তিনজন মোগল কর-সংগ্রাহককে বটগাছের সাথে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে আর শকুনদের খাদ্য হবার জন্য মৃতদেহগুলো সেভাবেই রেখে দিয়ে আমাদের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছে।
এই ধরনের একটা সংবাদই তো যথেষ্ট আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ছোটার জন্য। আবারো নিজের মতের উপর জোরারোপ করল মালিক আলী।
তাঁর ঘোড়াদের রাজা ছোট্ট একটা কুকুরের মত আচরণ করছে, একটা ইঁদুরকেও ছাড়তে নারাজ, ভাবলেন শাহজাহান।
এ জাতীয় কয়েকটা আন্দোলন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। যতক্ষণ পর্যন্ত এরা সংখ্যায় নগণ্য আর কার্যকরণেও ততটা আগ্রগামী নয়। আমাদের বর্তমান বাহিনীই যথেষ্ট তাদেরকে দমনের জন্য। আর বোকা ষড়যন্ত্রকারীদেরকেও তাদের যথোচিত শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু মীরাপুরের রাজার আচরণ একটু বিশেষ। নিজের বয়সের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। প্রায়, আর এ কথা শোনা যায় যে শাসনকাজ দেখা-শোনা করে তার তরুণী স্ত্রী–বিজাপুর রাজ পরিবারের সদস্য। স্ত্রীর সার্বক্ষণিক জোরাজুরিতে রাজা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে। যদি আমাদের সত্যিকারের কোন কারণ থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই চলার গতি দ্রুত করব অথবা দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশে অগ্রগামী সৈন্যদল পাঠিয়ে দেবো। এখন পর্যন্ত আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও দ্রুত এগোতে পেরেছি আমরা। এর চেয়ে দ্রুত ছুটলে আমাদের সৈন্যরা শুধু ক্লান্তই হবে। পশুদেরও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন, তাহলেই শত্রুর উপর আক্রমণ ফলপ্রসূ হবে। তাই শত্রুকে দ্রুত পরাজিত করতে আমিও আগ্রহী; কিন্তু গতি বাড়ালে তেমন একটা সুবিধা পাব না।