সারা শরীর কাঁপিয়ে ফোঁপাতে লাগল আবদুল আজিজ। জাহাপনা! ভৃত্যেরা আমার পিতার দাড়িতে লেগে যাওয়া আগুন নিভাতে পারেনি। চেহারা থেকে খসে পড়েছে পোড়া চামড়া…পুড়ে যাওয়া ঠোঁট…কথা বলতে পারেননি তিনি। কয়েক মিনিট পরেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তোমার পিতা একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমি। তুমিও তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তুমি ঘুমাতে যাও। বাকি কথা সকালে হবে।
আবদুল আজিজ প্রস্থান করতেই, তার পিতার মৃত্যুর খবরে কাঁপতে লাগল সৈন্যরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হারেমের দিকে চলে গেলেন শাহাজাহান। দক্ষিণে সৈন্যদল পরিষ্কারভাবেই পরাজিত হয়েছে। এক নতুন সেনাপতির অধীনে নতুন সৈন্যবাহিনী পাঠাতে হবে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। কিন্তু কে হবেন এই সেনাপতি?
যদি মহবৎ খান, সম্রাটের খান-ই খানান এই মুহূর্তে হিমালয়ের পাদদেশে নেপালের রাজা আর তার গুর্খা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত না থাকতো, তাহলে স্পষ্ট প্রথম পছন্দ ছিল সে-ই। কিন্তু তাকে ডেকে পাঠানো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
ঝরনা পার হতে হতে আরো বেশ কয়েকজন সেনাপতির নাম মনে মনে ভাবলেন শাহজাহান। বিশ্বস্ত বন্ধু কামরান ইকবাল, আগ্রা দুর্গের সেনাপ্রধান, তবে তাকে এখানেই বেশি প্রয়োজন। এছাড়া লাহোরে শাহরিয়ারের সাথে যুদ্ধে আহত ক্ষত থেকে এখনো সেরে ওঠেনি সে, পুরোপুরি হয়ত কখনোই সেরে উঠবে না।
শ্বশুর সাহেব আসফ খান বৃদ্ধ হয়েছেন। অভিযানে যাবার মত সামর্থ্য নেই এখন আর। অন্যান্য হয় বেশি রাগী অথবা বেশি সাবধানী। কয়েকজন আছে স্থানীয়দের সাথে বেশ খারাপ আচরণ করতে অভ্যস্ত, পারিশ্রমিক না দিয়েই তাদের শ্রম চায়। কিন্তু এ ধরনের আচরণ দাক্ষিণাত্যের গর্বিত আর অশান্ত স্বভাবের লোকদের সাথে খাটবে না। না। আর কোন উপায় নেই। তিনিই যাবেন, দক্ষিণে, তাঁকেই দিতে হবে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব।
কয়েক মিনিট পরে আরো একবার সোনালি অ্যামব্রয়ডারি করা মসলিনের পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন মমতাজের রুমে। পদ্মখচিত রেশমী কাপড়ের গোল বালিশে পিছন ফিরে শুয়ে তরমুজের রস পান করছেন মমতাজ। চোখ তুলে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আবদুল আজিজ কী চেয়েছে?
দাক্ষিনাত্যের বিরাট পরাজয় আর বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। আমাকে এখনই সেনাবাহিনী জড়ো করে রওনা দিতে হবে।
কখন রওনা দেবো আমরা?
আমি একা যাবো। তোমরা এখানে থাকবে।
দাক্ষিণাত্যে এই অভিযান অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা কেন? আমি সবসময় আপনার সঙ্গী হয়েছি আর আপনিও কখনো আপত্তি করেননি।
হ্যাঁ, তুমি আমার সাথে গেলে আমিও খুশি হতাম। যদি না জানা থাকতো যে তুমি আবার মা হতে চলেছ। শেষবার প্রথমগুলোর চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলে তুমি। এখানেই ভালো হাকিমের বন্দোবস্ত থাকবে।
যেমনটা আমি আপনার প্রথম অভিযানের সময়ই বলেছিলাম, আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে চাই না। সর্বশ্রেষ্ঠ হাকিমেরাও তো আমাদের সাথেই আসতে পারে।
হুম পারে সম্ভবত।
না, কোন সম্ভবত নেই। আমি, আমাদের ছেলেমেয়েরা আর আপনি যত হাকিম চান, সকলেই আপনার সাথে যাচ্ছি। একসাথে বিজয়ের উদ্দেশে রওনা হব আমরা।
বোঝা গেল কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না মমতাজ।
.
১.২
আগ্রা দুর্গের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে মলিন সূর্যের আলোয় নিজের তলোয়ার তুলে নিলেন শাহজাহান আর মাথার উপর তুলে তিনবার ঘোরালেন। ভোরের একেবারে শুরু হচ্ছে মাত্র। এই ইশারা পেয়ে, সেনাবাহিনীর গোলন্দাজেরা ছোট কামান থেকে গোলা ছুড়লো। দাক্ষিণাত্য থেকে আবদুল আজিজের বয়ে আনা সংবাদের পর থেকে দুর্গের নিচে যমুনা নদীর তীরে জড়ো হওয়া শুরু করেছিল সৈন্যরা। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল সকলে। এর বিশালত্বের দিকে তাকিয়ে–এমনকি পারস্যের শাহও এতবড় সুসজ্জিত দল একত্রিত করতে পারবেন না রণক্ষেত্রে, গর্ব ভরে ভাবলেন শাহজাহান।
প্রথম বিশ হাজার হল অশ্বারোহীদের অগ্রগামী সৈন্য। বাতাসে উড়ছে তাদের সবুজ সিল্কের তৈরি স্মারকচিহ্ন। এরপর হাতির পিঠে চড়ে চলেছে সম্রাটের বয়স্ক ও প্রধান সেনাপতির দল। জমকালো ভেলভেট আর সোনার কাপড় পরিহিত হাতিদের ঘণ্টা আর শিকলগুলো সোনা ও রুপার তৈরি হওয়ায় শব্দও বাজছে। এরপর দুধ-সাদা ষাঁড়ের দল টেনে নিয়ে চলেছে কাঠের গাড়িতে থাকা বিশাল ব্রোঞ্জের কামান। ষাঁড়ের শিঙে এর মাথায় সবুজ আর সোনালি ডোরাকাটা দাগ। এদের পেছেন এগোচ্ছে পদাতিক বাহিনীর বিশটি সারি, একেবারে পাশাপাশি অবস্থায় অনুসরণ করছে বিশাল রসদের সারি। রসদবাহী হাতিগুলোর পায়ের বদৌলতে মনে হচ্ছে ধুলার সাগরে জাহাজ চলেছে। এদের পেছনেই আছে উট, গরুর গাড়ির দল।
সময় হয়ে গিয়েছে সম্রাটের হাতি অগ্রসর হবার। দুর্গের চওড়া বহির্ঘার দিয়ে যখন তিনি বের হচ্ছেন, পেশীবহুল বাজনাবাদকেরা সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিল ঢাকের তালে তালে যে, মোগল সম্রাট যুদ্ধে চলেছেন। প্রদর্শনের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করো না, বিশেষ করে শক্তি প্রদর্শনকে। হাসি দিয়ে আকবর বলেছিলেন একদা শাহজাহানকে। তরুণ বয়সে এই ধাঁধা দ্বিধায় ফেলে দিত তাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে ঠিকই বুঝতে পারেন এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। জনগণের সামনে নিজের এবং তাঁর সাম্রাজ্যের ভাবমূর্তি যেন এতটুকু ক্ষুণ্ণ না হয়, শিখে ফেলেন শাহজাহান। অভিযান অথবা দরবার রাজকার্য পরিচালনা উভয় ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। আর এই কারণেই স্থাপত্যবিদদের আদেশ দিয়েছেন যেন তাঁদের অনুপস্থিতিতে আগ্রা দুর্গের সংস্কার কাজ করা হয়, বর্তমান বালি পাথরের প্রাসাদে লাগান হবে সাদা মার্বেলের আচ্ছাদন। রক্তলাল বালি পাথর ধারণ করে আছে তাঁর সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির নিদর্শন, অন্যদিকে সাদা মার্বেল ঘোষণা করবে সমৃদ্ধি আর প্রাচুর্যকে।