আমার পিতা অবিলম্বে আপনাকে এ সংবাদ জানাতে বলেছেন যে, দাক্ষিণাত্যের সম্রাটের সৈন্যরা কতটা দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। গোলকুন্ডা আর বিজাপুরের শাসকেরা আপনার প্রতি আনুগত্য ভুলে গিয়ে দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করেছে। আমাদের সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে দিয়ে সরাসরি ভূ-খণ্ডের গভীরে চলে এসেছে। আমার পিতা যুদ্ধ হাতি আর আধুনিক কামান দিয়ে সুসজ্জিত বিশাল সেনাবাহিনী একত্রিত করে তাপ্তি নদীর থেকে নব্বই মাইল দক্ষিণে তাদেরকে মোকাবেলা করেছেন। প্রথম দিকে আক্রমণকারীরা যুদ্ধ করতে পারছিল না, কিন্তু আমার পিতা তাদেরকে বাধ্য করেছেন।
তিনি একজন দক্ষ সেনাপতি।
হ্যাঁ জাহাপনা তিনি ছিলেন…দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আবদুল আজিতের মুখমণ্ডল। পুরো একদিন যুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু কোন পক্ষই সুবিধা করতে পারেনি। শুধুমাত্র গরম আর পানির অভাবেই আততায়ীর হাতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেনারা। সূর্যাস্তের দিকে খানিকটা পরাজিত হতে শুরু করে আক্রমণকারীরা। আমার পিতা শেষবারের মত তাদেরকে পিছু হটিতে দিতে অগ্রসর হয় নিজের ধূসর তেজী ঘোড়া নিয়ে…আমি অনুনয় করেছি আমাকে সাথে নিতে, কিন্তু আমার কাতরতা শোনেননি তিনি।
আবদুল আজিজের ধুলি ধূসরিত মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুবিন্দু। আমাদের ঘোড়সওয়ারদের দক্ষতায় আক্রমণকারীদের অনেকেই ধরাশায়ী হয়। আমার পিতা কামানের দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলে একজন গোলন্দাজ গোলা ছুঁড়ে বসে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গোলা এসে আঘাত করে পিতার ডান বাহুতে, আমাদের লোকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছিলেন তিনি তখন। কনুই থেকে পুরো পেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু শত্রুবাহিনী পিছু না হটা পর্যন্ত কোন চিকিৎসা নিতে রাজি হননি তিনি। এরপর হাকিম ক্ষত পরিষ্কার করে রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন। ব্যথা প্রচুর রক্তক্ষরণের পরেও এই রাতে ভালোভাবেই নিদ্রা গিয়েছেন পিতা আর আমিও আশা করে ছিলাম যে তিনি দ্রুতই সেরে উঠবেন… থেমে গেল আবদুল আজিজ।
পরের দিন সকাল বেলা পিতা আবারো শত্রুর পিছু নেবার হুকুম দেন। আমাদের চরের মাধ্যমে জানা যায় যে শত্রুবাহিনী দক্ষিণে ছুটছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনের দুপুর বেলা দুপাশে পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা বেয়ে নামার সময় হঠাৎ করেই গোলকুন্ডার বিশাল বড় এক অশ্বরোহী বাহিনী এসে আমাদের পথরোধ করে। কোন আদেশের আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আমাদের সৈন্যরা। প্রথম আঘাতেই আমাদের সারি ভেঙে দুটুকরা হয়ে যায়। পেছনদিকে চক্রাকারে এগিয়ে আসে আক্রমণকারীরা। সেখানেই ছিল কামান আর রসদবাহী গাড়ি। কাটতে কাটতে এগিয়ে আসে শত্রুরা। বিশৃঙ্খলার মাঝে পড়ে যায় আমাদের লোকেরা। কয়েকজন পালিয়ে যায় কিন্তু কিছু কাপুরুষ বৃথাই এই চেষ্টা করে, কেননা পেছন থেকে তাদেরকে মেরে ফেলে গোলকুন্ডার ঘোড়সওয়ারা।
পেছনের বাকি সৈন্যরা চেষ্টা করে একত্রিত হয়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে। অন্যদিকে সামনের অংশে বাকি সৈন্যদের নিয়ে পিতা চেষ্টা করেন বন্দুকবাজদের প্রস্তুত করতে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয় শত্রুদের পিছু হটাতে। অশ্বারোহীদের বেশিরভাগ এসে পিতার পাশে জড়ো হয়, কিন্তু পদাতিকেরা হয়ে পড়ে সংখ্যায় নগণ্য। আমি দেখেছি কমলা পোশাক পরিহিত একদল পদাতিক রাজপুত শত্রুবাহিনীর অশ্বরোহীদের বর্শার আঘাত ঠেকাতে এক হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকবার রাজপুতদের তলোয়ারের আঘাতে গর্জে ওঠা ঘোড়া ফেলে দিয়েছে আরোহীকে। কিন্তু এটা ছিল অসম প্রতিযোগিতা। খুব কম সুযোগই পেয়েছে রাজপুত সৈন্যরা তাদের অস্ত্র ব্যবহার করার। তাই ফলাফল ছিল একটাই। শুধুমাত্র দুজন রাজপুত ফিরে আসতে পেরেছে আমাদের সারিতে। দুজনেই প্রচুর রক্ত হারিয়েছিল। এরপর আক্রমণকারীরা জ্বলন্ত ন্যাকড়া বাঁধা তীর ছুঁড়ে মারে। ফলে ভয় পেয়ে যায় আমাদের যুদ্ধ হাতিরা। কয়েকটা তো এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে একে অন্যের সাথে গুতোগুতি শুরু করে দেয়, অস্ত্রের মুখ ঘুরে যায়।
পিতা আদেশ দেন বাকি সৈন্যরা যেন উপত্যকার শেষপ্রান্তের কাছাকাছি নিচু পাহাড়ে চলে যায়, সেখানে গিয়ে আমরা আবার একত্রিত হবার সুযোগ পাবো। শত্রুপক্ষের উপর্যুপরি আক্রমণ সত্ত্বেও আমরা সেই রকমই করলাম। কাছাকাছি পৌঁছতেই পর্বতে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন শত্রু তীরন্দাজ তীর ছোড়ে। তিনটা তীর এসে পিতাকে বহনকারী পালকিতে আঘাত করে। দুইটা তীর সাথে সাথে আগুন ধরিয়ে দেয়, তৃতীয়টা পিতার উরুতে আঘাত করে। কাপড়ে আগুন ধরে যায়। সাথে সাথে পিতার ভূতেরা আগুন নিবিয়ে তাঁকে বাইরে বের করে আনে। চেতনা থাকলেও পিতা বেশ বুঝতে পারেন যে এই ক্ষত সারিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই হাকিমের।
ব্যথার সাথে যুদ্ধ করে তিনি নেতৃত্ব তুলে দেন সেকেন্ড ইন-কমান্ড জাকির আবাসের হাতে। নির্দেশ দেন যতটা সম্ভব সুশৃঙ্খলভাবে পিছিয়ে যেতে। এরপর আমাকে ডেকে পাঠান। আমার হাত ধরে নির্দেশ দেন যেন এই পরাজয়ের খবর পৌঁছে দিই আপনার কাছে…আপনাকে জানাতে বলেছেন যে সৈন্যদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত আর এই মুহূর্তে সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী না পাঠানো হলে দক্ষিণে আমাদের ভূ-খণ্ড হাতছাড়া হয়ে যাবে।