ইসমাইল খান। আমার রক্ষীদেরকে সরিয়ে ছুরি মেরেছে।
জানির ভ্রাতুস্পুত্র? কিন্তু ও তো একটা ছোট ছেলে…কেন? কী হয়েছে ওর? আর আপনিই বা কী করেছেন তার সাথে?
সে জানির হয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে শাস্তিও পেয়েছে। আমি বরঞ্চ দয়াই দেখিয়েছি–আমি তাকে দ্রুত মৃত্যু অনুমোদন করেছি। আমি তাকে বাঁচতে দিতে পারি না…আমাকে হত্যা করার চেষ্টার পর তো নয়ই।
সম্ভবত না, কিন্তু… থেমে গেলেন মমতাজ।
শাহজাহান আলতো করে নিজের হাতের মাঝে ধরলেন পত্নীর মুখ। বললেন, বিবাহের পর থেকে আমি যা কিছু করেছি তা আমাদের জন্য, আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য…আমাদের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যতের জন্য।
আমি কখনো এমনটা সন্দেহ করিনি, কখনো না…এত বছরে না। কিন্তু এর মাধ্যমে কিছুতেই নিজেকে অপরাধী হিসেবে ভাবা বন্ধ করতে পারছি না। খানিকটা ভয়ও পাচ্ছি। আমরা যা চেয়েছি পেয়েছি, কিন্তু এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে রক্ত দিয়ে।
হাত নামিয়ে নিলেন শাহজাহান। যদি আমি তাদেরকে হত্যা না করতাম তাহলে আমার সম্ভাইয়েরা আমাকে হত্যা করত…আমাদের পুত্রদেরও। তাদের মৃত্যুতে আমি গর্বিত নই, কিন্তু এগুলোর প্রয়োজন ছিল। এটা বললে মিথ্যে বলা হবে যে আমি এ কাজ অসমাপ্ত রাখতে চেয়েছি। যদিও অতীত এসে প্রায়ই জ্বালাতন করে আমাকে–আমি জানি তোমাকেও কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই।
আপনি তা-ই করেছেন, যা করার দরকার ছিল…আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেমন হবে যদি ইসমাইল খানই হয় প্রথম? আর কত জন আছে যারা আপনার কাজের প্রতিশোধ নিতে চাইবে?
আমি মোগল সম্রাট আর শত লক্ষ্য আত্মার পরিচালক। তাই আমার জীবনে ঝুঁকি থাকবেই। কিন্তু আমি আমার আর আমার পরিবারকে রক্ষা করবই…এর কখনো অন্যথা হবে না। আমি সকলকে নিরাপদে রাখব, প্রতিজ্ঞা করছি।
*
রৌপ্য সিংহাসনে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করছেন শাহজাহান। সারি বেঁধে এগিয়ে আসলো বারোজন রাজকীয় ভৃত্য। সবার হাতে একটি করে সোনালি মোমদানি যার মাথার জ্বলছে লম্বা কর্পূরের সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি। দরবারের সামনে এসে প্রত্যেকেই একবার করে কুর্নিশ করল সম্রাটকে, এরপর মোমবাতি নিয়ে চলে গেল দিয়া জ্বালাতে। বিশাল পাত্রের মাঝে সরষের তেলে ডুবানো সলতে–দুর্গের আঙিনার চারপাশে রাখা আছে পিতলের দিয়াগুলো। রক্ষীবাহিনীর নেতার নেতৃত্বে কাজ শেষ করল সকলে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাটকে জানালো, রাতের জন্যে দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে জাহাপনা। এরপর শাহজাহানের পছন্দের দরবার শিল্পী–গভীর সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী, তরুণ তাজিক গেয়ে উঠল সম্রাটের নামে প্রশস্তিগীতি আর তাঁর পবিত্র শাসনামল অক্ষত টিকে থাকার জন্য প্রার্থনা সঙ্গীত। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এই নিশি জাগরনী অত্যন্ত উপভোগ করেন শাহজাহান। দাদাজানের সফল শাসনামলের সাথে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল এই সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসূরী তিনিই; মাথা নত করে রাখা রক্ষীবাহিনীর সামনে দিয়ে এরপর উঠে চলে গেলেন হারেমে, মমতাজের কাছে। হাতে ধরা সবুজ ভেলভেট রিবনে বাঁধা একতোড়া কাগজ।
আমি তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি-দরবারের একজন কবি তোমার নামে কবিতা রচনা করেছেন। নিচু হয়ে মমতাজের অধর চুম্বন করলেন শাহজাহান।
কী লেখা আছে এতে?
একটু বেশি বাক্যালংকারপূর্ণ হলেও আমার ভাবনাই ফুটে উঠেছে।
হতে পারে, কারণ আপনি তাকে আগেই বলে দিয়েছেন যে কী লিখতে হবে।
হুম, যাই হোক, হতে পারে। পড়ব?
অবশ্যই। বলে উঠলেন মমতাজ। হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে। রিবন খুলে পড়া শুরু করলেন শাহজাহান :
তাঁর আচরণের কোন ধুলাই
ছায়া ফেলে না সম্রাটের মনের আয়নায়
তিনি সব সময় রাজাকে খুশি
করার চেষ্টায় রত;
ভালোভাবেই জানেন রাজাদেরও
রাজার অনুভূতি।
তার চোখে খেলা করে আলো
কিন্তু শেষ করার পূর্বেই দরজার সোনালি তারকা আর চন্দ্রখচিত অ্যামব্রয়ডারি করা পাতলা মসলিনের পর্দা সরিয়ে এগিয়ে এল সাত্তি আল-নিসা।
কী হয়েছে? জানতে চাইলেন শাহজাহান, আমি আদেশ দিয়েছি যেন বিরক্ত না করা হয়।
আমি দুঃখিত জাহাপনা। কিন্তু দক্ষিণ থেকে আবদুল আজিজ এসে পৌঁছেছে। আমি তাকে জানিয়েছি যে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী রাতের জন্য বিশ্রাম করছেন, কিন্তু আপনার সাথে দেখা করার জন্য তাড়া করছে সে।
আমি আসছি। জানিয়ে দিলেন শাহজাহান। কী এমন ঘটেছে যে দাক্ষিণাত্যে তাঁর সেনাপতির পুত্র এত রাতে দেখা করার জন্য জেদ করছে? একটা ব্যাপার তো নিশ্চিত যে, কোন দুঃসংবাদই হবে। তাড়াহুড়োয় কক্ষ ছেড়ে হারেমের আঙিনা দিয়ে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। চাঁদের আলোয় চকচক করছে দুই সারি ঝরনা। গেট হাউছে পৌঁছে মশালের আলোয় এ মাথা থেকে ও-মাথা পায়চারি করতে থাকা কৃশকায় আবদুল আজিজকে দেখতে পেলেন। সম্রটাকে প্রধান আঙিনায় নেমে আসতে দেখে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তরুণ। তারপর হাঁটু গেড়ে সম্রাটকে সম্মান জানাল।
উঠে দাঁড়াও। নির্দেশ দিলেন শাহজাহান। আবদুল আজিজ উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেল তার সারা গায়ে ঘাম আর ধুলা। সম্রাটের সামনে আসার আগে এমন কি গোসল করে পোশাক পরিবর্তনের কথাও খেয়াল নেই। কী কারণে তোমাকে এত তাড়াহুড়োয় আমার কাছে নিয়ে এলো?