*
না…না…রোশনারা…!
সম্রাজ্ঞী, কী হয়েছে?
জেগে গেলেন মমতাজ। সারা শরীর কাঁপছে। কপাল ঘেমে একসা। সাথে সাথে বিশালদেহী পারস্যবাসী ভৃত্য সাত্তি আল নিসা হলুদ সিল্কের রুমাল দিয়ে মুছে দিল ঘাম। আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি আর সম্রাট উন্মত্ত মহনদী নদীতে ষাঁড়ের গাড়ি দিয়ে পার হবার সময় একটা জন্তু পা হড়কে পড়ে যায়, গাড়ি উল্টে যায়…ঢেউ এসে রোশনারাকে নিয়ে যায় আমার কোল থেকে…আমি সাঁতার কেটে ওর কাছে যাবার চেষ্টা করলেও পারি নি…আমি বুঝতে পারছিলাম যে মেয়েটা ডুবে যাচ্ছে কিন্তু পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি নিজেও…মাথার উপরে পানি গলার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে পানি…আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
শশশ। কিছুই হয়নি সম্রাজ্ঞী। আপনি আবারো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। রোশনারা জাহানারার কাছে আছে। আমি মাত্র আধা ঘণ্টা আগেও আপনার মেয়েদেরকে একসাথে দেখেছি। এত নরম স্বরে সাত্তি-আল নিসা কথা বলতে লাগল যেন চল্লিশ বছর বয়স্ক কোন ম্রাজ্ঞী নয়, সে কথা বলছে কোন শিশুর সাথে। স্বস্তির সাথে আবারো শুয়ে পড়লেন মমতাজ। কিন্তু আরো কয়েক মিনিট কাটার পর অবশেষে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি থেমে গেল। মধ্যাহ্নের খাবারের পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঘরময় ছায়া এখন। এতক্ষণ নিশ্চয়ই ঘুমাননি তিনি। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে ঘুমানোর পরে জানালাগুলোতে তত্তি সুগন্ধময় কাশফুলের শিকড়ের ঘাস দিয়ে তৈরি পর্দা দিয়ে গেছে ভৃত্যেরা, যেন গ্রীষ্মের কড়া রৌদ্র কামরাতে ঢুকতে না পারে। ফোঁটা পড়ার শব্দে তিনি এও বুঝতে পারলেন যে পর্দার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে দিয়ে গেছে তারা, যেন বাতাসও সুগন্ধময় হয়ে ওঠে।
মমতাজ পাশ ফিরে শুলেন, চিকন রশ্মির মত করে সূর্যের আলো আসছে পর্দা ভেদ করে, কাউচের চারপাশে দামি পারস্যের কার্পেটের উপর নাচছে আলোর পুকুর। মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্তের কথা যখন তাঁর ছোট কন্যা প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল পানিতে। শাহজাহান বাঁচিয়েছিলেন মেয়েকে। সম্রাটের সেই দুঃখ ভরা দৃষ্টি মমতাজ কখনো ভুলতে পারবেন না–পানিতে ভিজে চুপচুপে মেয়েকে কোলে দিয়েছিলেন শাহজাহান, কিন্তু তখনো নিঃশ্বাস ফেলছিল রোশনারা–শাহজাহানের পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে সারা ভারত চষে বেড়াচ্ছিলেন তারা, শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল। অবাক লাগে ভাবতে যে, এখন তিনি ম্রাজ্ঞী, নিরাপত্তা আর আয়েশে মোড়ানো জীবন, তারপরও ও সেই দিনগুলি কখনো মনে পড়ে যায়। কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবেন রোশনারার কী কিছু মনে আছে, যদিও সে অনেক ছোট ছিল তখন। মমতাজের অন্য ছেলেমেয়ের চেয়ে রোশনারাই বেশি চাইতো মায়ের কাছে থাকতে। মায়ের অনুপস্থিতি অনেক দিন ধরে ভয়ে ফেলে দিত মেয়েটাকে।
সাত্তি আল-নিসা, আমার আদেশ জানিয়ে দাও, আমি চাই আমার ছেলে-মেয়েরা আজ সন্ধ্যায় আমাদের সাথে খাবার গ্রহণ করবে। তাদের সাহচর্যে উদ্দীপনা ফিরে পাবেন, ভাবলেন মমতাজ। এখন যখন খুশির দিন এসেছে, অন্ধকারের কথা ভাবাতে নিজের উপরই বিরক্তি এলো মনে। ছয়টি সন্তানই কি প্রমাণ নয় যে অতীতের পরীক্ষা সত্ত্বেও আল্লাহ তার সাথে আছেন? আর এখন শুধু এটুকুই যথেষ্ট যে একে অপরের সাথে যতটা পারা যায় সময় কাটানো উচিত। দুই সপ্তাহের মাঝে দারা শুকোহ আগ্রা ছেড়ে যাবে পারস্যের শাহের দরবারে মোগল দূতাবাস স্থাপন করতে। শাহজাহানের মতে, চৌদ্দ বছরের কাছাকাছি বয়স্ক দারা শুকোহ্ কয়েকদিনের মাঝেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষে পরিণত হবে। তাই রাজকীয় কাজের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। একমত হয়েছেন মমতাজ।
মনে প্রশান্তি ভাব আসতেই আড়মোড়া ভাঙ্গলেন তিনি। শীঘ্রই তৈরি হতে হবে আসন্ন সন্ধ্যার জন্য। সেবা দাসীরা সুগন্ধি তেল লাগিয়ে দেবে মসৃণ দেহত্বকে, চোখে কাজল আর এমন পোশাকে অঙ্গ সাজিয়ে দেবে যেভাবে ম্রাজ্ঞীকে দেখতে পছন্দ করেন সম্রাট। মসলিনের পায়জামা যেটিকে দরবারের কারিগররা নাম দিয়েছে বহতা পানি আর অ্যামব্রয়ডারি করা চোলি। হঠাৎ করেই মমতাজ শুনতে পেলেন ড্রামের শব্দ, যার অর্থ সম্রাট হেরেমে প্রবেশ করেছেন। অবাক হয়ে উঠে বসলেন তিনি–এমনটা তো হবার কথা না…সাধারণত সূর্য ডোবার পরেই আগমন ঘটে সম্রাটের। খানিক পরেই জোড়া দরজা মেলে ধরল ভৃত্যেরা, প্রবেশ করলেন শাহজাহান।
একবার তার দিকে তাকিয়েই মমতাজ বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা ঘটেছে। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? কী ঘটেছে?
কিছুই না বলে নিজের কাছে পত্নীকে টেনে নিলেন শাহজাহান। মমতাজের শরীরের উষ্ণতা, চুলের পরিচিত জেসমিনের সুগন্ধ পেয়ে মনে মনে আবারো ধন্যবাদ জানালেন যে, ইসমাইল খান সফল হতে পারেনি। তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। কিন্তু যাদেরকে ভালোবাসেন তাদেরকে ছেড়ে যাওয়া…অবশেষে ছেড়ে দিলেন মমতাজকে। কোট ঠিক করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসলেন। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত দেখতে পেলেন মমতাজ। আপনার সাথে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে?
না, দুর্ঘটনা নয়। আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে…চিন্তা করো না, চিন্তার কিছু নেই। মাংস কেটে গেছে। হাকিম এর পরিচর্যা করে দিয়েছে।
কে? ভয়ত কণ্ঠে ফিসফিস করে উঠলেন মমতাজ।