তো ঘটনা তাহলে এই, ভাবলেন শাহজাহান। চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন হরি সিংয়ের দিকে। লোকটা এখনো শাহরিয়ারের অনুগত, যেমনটা ছিল ইসমাইল খান জানি আর খসরুর প্রতি। নিজেকে বাঁচাতে কী বলার আছে তোমার?
সরাসরি শাহজাহানের দিকে তাকাল হরি সিং। জাহাপনা! আমি। পিছনে হটিনি, শপথ করে বলছি। আমি চেষ্টা করেছি আপনাকে রক্ষা করতে…ইসমাইল খানকে থামাতে। পা জোড়া ধরে মাটিতে ফেলে দিতে প্রায় সমর্থ হয়েই যাচ্ছিলাম। অন্যরা পরিষ্কার দেখেছে।
আর মজিদ বেগ? যেমনটা সে বলেছে ঠিক সেভাবে চেষ্টা করেছিল?
আমি জানি না। এছাড়া সেও আমার সহযোদ্ধা।
ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। হরি সিং, তোমাকে বলতেই হবে।
হরি সিং আবার কিছু বলার আগেই শাহজাহান দেখতে পেলেন দেহরক্ষীদের নেতা এগিয়ে এল শুকনো প্যারেড গ্রাউন্ডে। বাতাসের তোড়ে লাল ধুলো উড়তে শুরু করেছে। কী হয়েছে?
আপনি যেমনটা নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমরা ওদের মিলিটারি ব্যারাকে খোঁজ করে এই ব্যাগটা পেয়েছি। কথা বলতে বলতে দেহরক্ষীদের নেতা এক হাতে সবুজ রঙের একটা ভেলভেটের ব্যাগ তুলে ধরল। নিচে ধুলার উপর গড়িয়ে পড়ল বেশ কয়েকটা সোনার মোহর।
কার থলে এটা? জানতে চাইলেন শাহজাহান।
মজিদ বেগের।
এটা হরি সিংয়ের নয়, জানতে পেরে বিস্মিত শাহজাহান। কিছুই না বলে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর জানতে চাইলেন, এগুলো কী মজিদ বেগ? ষড়যন্ত্রের পুরস্কার?
না, আমার সঞ্চয়। নিজের কথায় অটল রইল মজিদ বেগ।
এটা সত্যি নয়, জাহাপনা, কথা বলে উঠল দেহরক্ষী প্রধান। অন্য প্রহরীদের একজন আমাকে জানিয়েছে যে জুয়ারী হিসেবে খ্যাতি আছে মজিদ বেগের আর এখন সে মেয়ের বিয়ের যৌতুক মেটাতে অর্থ জোগাড় করছে। সেই-ই অপরাধী।
হরি সিং, এবার তুমি বলো। তাগাদা দিলেন শাহজাহান।
আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোন সহকর্মীকে দোষ দিতে পারি না। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে আমার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল। আস্তে করে বলে উঠল হরি সিং। তবে এবার তার চোখ মাটির দিকে নামিয়ে রাখল। এ সময় মজিদ বেগ চাইল মরিয়া হয়ে প্রহরীদের হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিতে, কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল প্রহরীরা।
মজিদ বেগ, এটা তোমারই কাজ।
হা, জাহাপনা।
কে বলেছে করতে?
মজিদ বেগ একেবারে ভেঙে পড়ল। ইসমাইল খান। আমাকে এও বলেছে যে এক প্রহরীর কাছ থেকে আমার অর্থের প্রয়োজনের কথা শুনেছে।
আর কেউ জড়িত ছিল?
না…আমার জানা মতে না, জাহাপনা।
ইসমাইল খানের মত তুমিও মারা যাবে মজিদ বেগ। কিন্তু তার মত করে না, কেননা তুমি আরেকজন নিরপরাধ ব্যক্তির উপর দোষ দিতে চেয়েছে। তোমার মৃত্যু হবে হাতির পায়ের নিচে। জল্লাদ হাতিকে সামনে নিয়ে এসো।
ধীরে ধীরে বিশাল বড় এক হাতি, কানের কিনারা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল বয়সের ভার, দুর্গের দেয়াল থেকে বের হয়ে সামনে এলো। পিঠের উপর বসে আছে হাতির মতই বয়সের ভারে ন্যূজ মাহুত। একই সাথে প্রহরীর দল টানতে টানতে মজিদ বেগকে গ্রানাইটের পাথরের তৈরি মঞ্চের উপর নিয়ে গেল। চার কোণায় থাকা লোহার আংটার সাথে বেঁধে ফেলা হল মজিদ বেগের হাত আর পায়ের গোড়ালি। প্রথমে মনে হল কোন বাধা দেবার চেষ্টা করল না সে, বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল ভাগ্য। জল্লাদ হাতি এগিয়ে এল পাথরের দিকে। মজিদ বেগের উপর পড়ল ছায়া। আস্তে করে ডান পা উঁচু করল মজিদ বেগের পেট লক্ষ্য করে, এবার নড়ে উঠল মজিদ বেগ। ছাড়া পাবার জন্য যুদ্ধ শুরু করে দিল, চিৎকার করে বলে উঠল, আমার অতীতের কাজ স্মরণ করুণ, জাহাপনা! আমাকে ক্ষমা করুন!
আমি তা করব না। উত্তর দিলেন শাহজাহান। হত্যা করো।
নিজের হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে হাতির মাথায় আঘাত করল মাহুত, মজিদ বেগের পেটের উপর পা নামিয়ে আনল হাতি। পশুর মত চিৎকার করে উঠল মজিদ বেগ। পেলভিক হাড় ভাঙ্গার শব্দ শোনা গেল। শক্ত গ্রানাইটের সাথে চুরমার হয়ে গেল হাড়। পাকস্থলীর দেয়াল ছিঁড়ে যেতেই বাতাস বের হয়ে এলো। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই থেমে গেল সব চিৎকার।
মাহুতের কাছ থেকে আরেকটা নির্দেশ পেয়ে আবারো পা তুলল হাতি। আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে হাঁটা ধরল দুর্গের দিকে। ডান পায়ের প্রতি পদক্ষেপের সাথে রক্ত মাখা কমলা রঙের ধুলা উড়তে লাগল বাতাসে।
তো, শেষ হল আরেকজন বিশ্বাসঘাতক। ভিড়ের জনতার চিৎকার শুনে আবারো বলে উঠলেন শাহজাহান। এরপর ফিরে তাকালেন হরি সিংয়ের দিকে। তুমি মুক্ত আর তোমার প্রত্যাখানের জন্য–এমনকি তোমার নিজের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল–মজিদ বেগের অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েও কিছু বলনি, ধুলার মাঝে পড়ে থাকা মোহরগুলো নিয়ে যাও। মজিদ বেগের বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য তোমার বিশ্বস্ততার পুরস্কার।
প্রহরি হরি সিংয়ের হাতের বাঁধন কেটে দিতেই নিচু হয়ে মোহর কুড়াতে লাগল সে। দুর্গের দিকে ফিরে গেলেন শাহজাহান। হাত নেড়ে সরিয়ে দিলেন সভাসদদের শুভেচ্ছা। শাহানশাহের বেঁচে যাওয়া আর নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে চেয়েছিল তারা। শাহজাহান যেতে চান হারেমে, মমতাজের কাছে। ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগানোর সময়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু না জানানো হয় মমতাজকে। শাহজাহানের কাছ থেকে শুনলে আর নিজ চোখে দেখলে যে তিনি সুস্থ আছেন হয়তো মমতাজের আশংকা কেটে যাবে। কিন্তু একই সাথে মমতাজ হয়ত এও চেষ্টা করত যেন ইসমাইল খানকে ক্ষমা করে দেন শাহজাহান। জানির ভয়ংকর সমাপ্তি স্বামীর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে গরম কয়লা গিলে ফেলেছিল–এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় মমতাজকে। কিন্তু যেহেতু শাহজাহান মমতাজকে খুশি করতে চান, একবারের জন্য তিনি তাঁর অনুরোধ মেনে নিতে পারলেন না।