আর কে সাহায্য করেছে তোমাকে কোন সাহায্য ছাড়া আমার দেহরক্ষীদের হাত থেকে নিশ্চয়ই ছাড়া পাওনি?
আমাকে কেউ সাহায্য করেনি। পারিবারিক সম্মানের জন্য এমনটা করেছি আমি। ইসমাইল খানের তরুণ চোখ জোড়াতে ফুটে উঠল আত্মপ্রত্যয়। চিবুক সামনে বাড়িয়ে বলে উঠল, আমিই সব দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি জানতাম যে যদি সফল হইও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না। আপনার মৃত্যু কোন অপরাধ হত না। বরঞ্চ আপনার পাপের শাস্তি হত। আপনাকে হত্যা করে আমি আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাই পূর্ণ করতাম।
ইসমাইল খানের চেহারার দিকে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন শহীদের সত্যিকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাব। এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে গেলেন যে এ আক্রমণের পুরো পরিকল্পনা তার একার। কিন্তু তারপরেও নিশ্চয়ই কেউ ছিল সাথে। হতে পারে নির্যাতনের মাঝেও তাদের নাম বলবে না। তাহলে দেরি কিসের? জল্লাদ, তোমার কাজ সেরে ফেলল।
শাহজাহানের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল জল্লাদ। এগিয়ে এলো সামনে। স্থূলকায় লোকটার পরনে লাল পোশাক। সাথে লাল চামড়ার অ্যাপ্রন। হাতে খোলা তলোয়ার দুই ফুট লম্বা, মাথার দিকে খানিকটা বাঁকানো। তাড়াতাড়ি করে মাটিতে পাটের একটা ম্যাট পেতে দিল তার এক সহকারী। দুজন প্রহরী ধাক্কা দিয়ে এর উপর নিয়ে আসলো ইসমাইলকে। গলা বাড়িয়ে দাও। আদেশ দিল জল্লাদ। এক মুহূর্ত পরেই তার তলোয়ার সূর্যের আলো ঝিক করে উঠল ইসমাইলের উপর, ঠিক যেমন করে তরুণের ছোরা ঝিক করে উঠেছিল শাহজাহানের উপর। কিন্তু ইসমাইল খানের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে। হাত দুটো পিছনে বাঁধা; তাই নিজেকে বাঁচানোর কোন সামর্থ্য নেই তার। মসৃণ চামড়ায় দ্রুত বসে গেলো তলোয়ার। নরম মাংস ভেদ করে ঢুকে গেল ঘাড়ে। এরপর হাড় আর মাংসপেশী হয়ে কবন্ধ থেকে পৃথক হয়ে গেল ধড়। এক মুহূর্তের জন্য খোলা চোখ তাকিয়ে রইল শাহজাহানের দিকে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই দ্বিখণ্ডিত শরীর থেকে রক্তের ফোয়ারা ছোটার আগেই জল্লাদের দুই সহকারী পাটের ম্যাটের উপর মাথা আর শরীর পেঁচিয়ে তুলে নিয়ে গেল।
প্যারেড গ্রাউন্ডের ধারে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। খানিকটা আরাম বোধ করলেন শাহাজাহান। যদিও জীবন তাঁকে ভালোই শিক্ষা দিয়েছে যে মানুষের স্নেহ ভ্রম ছাড়া কিছু নয়। যদি ভাগ্য তার সাথে না থাকে তাহলে তারা তাঁর মৃত্যুতেও হাততালি দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে এরকম যেন না হয়। এছাড়া যদিও তিনি ইসমাইল খানকে সম্মানজনক মৃত্যুবরণ করার সুযোগ দিয়েছেন, তার আত্মাহীন মৃতদেহের সাথে তো এমনটা করা যাবে না। দুই হাত তুলে জনতাকে শান্ত করে বলে উঠলেন শাহাজাহান, তো, সকল বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি আমার পুরস্কার হবে একই, তাদের পদমর্যাদা যাই হোক না কেন অথবা আমার সাথে যত আত্মীয়তাই থাকুক না কেন। তাই আমার প্রজাদেরকে ভাগ্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য ইসমাইল খানের শরীরকে টুকরো টুকরো করে পচন না ধরা পর্যন্ত বাজারের প্রতিটি কোণায় ঝুলিয়ে রাখা হোক। খণ্ডিত মস্তক গেঁথে দেয়া হোক দুর্গের প্রধান দরজার মাথায়।
যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন, গর্জন করে উঠল ভিড়ের জনতা। এছাড়াও শোনা গেল নানা প্রশস্তিসূচক বাক্য। জিন্দাবাদ সম্রাট শাহজাহান। সম্রাট শাহজাহান চিরজীবী হোন। যদিও তিনি ভালোভাবেই জানেন যে ষড়যন্ত্রে জড়িত আছে তাঁর রাজ কর্মকর্তারাও।
এখনো শেষ করেননি শাহজাহান। হাতে সেলাই করার সময় কামরান ইকবালের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি বহু দিনের সঙ্গী, পিতা আর সভাতৃদ্বয় খসরু আর শাহরিয়ারের সাথে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধের সময়ও শাহজাহানের সাথী ছিল কামরানই ইসমাইল খান যে প্রহরীদের সহায়তা নিয়েছিল তাদেরকে চিহ্নিত করে আটক করার ব্যাপারে। শাহজাহান নিশ্চিত যে অন্তত একজন হলেও পাওয়া যাবে।
বন্দিদেরকে নিয়ে এসো। নির্দেশ দিলেন তিনি। কয়েক মিনিট পরে মোগল দেহরক্ষীদের সবুজ পোশাক পরিহিত দুজন রক্ষী সামনে এলো কিন্তু তাদের লোহার দেহবর্ম আর হেলমেট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দুই হাত একত্রে কব্জির কাছে বেঁধে রাখা। দুর্গের দেয়ালের ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে তাদেরই সশস্ত্রসঙ্গীরা নিয়ে এলো দুজনকে। এরপর শাহজাহানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। কয়েক গজ সামনে দাঁড়ালেও দুজনকেই চিনতে পারলেন শাহজাহান। প্রথম জন হরি সিং, লাহোর থেকে আগত এক সামরিক পরিবারের সদস্য। শাহরিয়ারের সময়েও নিয়োজিত থাকা এ লোকের দাদাজানের অনুরোধে এ দায়িত্ব দিয়েছে তাকে শাহাজাহান। সেই দাদাজান আবার তার নিজের দাদাজান সম্রাট আকবরের সমসাময়িক সঙ্গী ছিলেন। দ্বিতীয় জন একজন উজবেক, মজিদ বেগ, বহু বছর ধরেই আছে শাহজাহানের সশস্ত্রবাহিনীতে। উভয়কেই বেশ শান্ত দেখাচ্ছে।
কামরান ইকবাল আমাকে জানিয়েছে যে, ইসমাইল খান তোমাদের দুজনকে হটিয়ে আমার উপর আক্রমণ করেছে। কেন তোমরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে? কেন তাকে থামালে না? সে তো খুব বেশি একটা শক্তিশালীও নয়। উত্তর দিল না কেউই। কথা বল নয়তো লোহা গরম করতে বলব।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মজিদ বেগ, আমার মনে হয় হরি সিং একটু দূরে সরে গেছে যখন ইসমাইল খান আমাদের দুজনের মাঝে দিয়ে পার হয়ে গেছে। যদিও আমি তাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করেছি।