সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলেন বিজাপুর আশ্রয়স্থলের গাছের ডালগুলো একের পর ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বের হয়ে পড়ল ইতিমধ্যে গোলা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত কামানের নল। গোলন্দাজও হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে কামানের পেছনে। লম্বা ব্যারেলের অস্ত্র প্রস্তুত হয়ে গেল নিমিষেই। কামান আর গোলার বল লক্ষ্য খুঁজে পেল।
নিজের ঘোড়সওয়ারাদের সৃষ্টধুলার ফাঁক দিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন পা ভেঙে পড়ে গেল সামনের সারির একটা মোগল ঘোড়া। পড়ে যেতেই জায়গাচ্যুত হল পতাকাবাহক মাথা ফেটে গেল মাটির সাথে। একটু পরেই পিছন থেকে এগিয়ে আসা ঘোড়সওয়ারদের পায়ের চাপে আরোহী আর ব্যানার দুটোই নাই হয়ে গেল। কিন্তু এখন পড়ে যাচ্ছে অন্যরাও। একটা আহত ঘোড়া পা ভেঙে পড়ে রইলো রাজপুত অশ্বরোহীদের পথের উপর। দুজন সৈন্য সময়মতো নিজ নিজ ঘোড়ার লাগাম না টেনে ধরতে পারায় তিনজনেই একসাথে রক্ত-মাংসের দলা পাকিয়ে গেল। যাই হোক বিপর্যয় সত্ত্বেও শাহাজাহান ও তাঁর সৈন্যেরা যত শক্তি নিয়ে সম্ভব এগিয়ে গেল সামনে দিকে। খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল শত্রুদের কাছাকাছি, ফলে সবাই মিলে একটা জায়গায় যুদ্ধে লেগে যাওয়ায় গোলন্দাজরাও কিছু করতে পারল না, কারণ শত্রু-বন্ধু আলাদা করা দায় হয়ে পড়ল।
একেবারে শেষ মুহূর্তে সামনে দেখা গেল একটা কাঁটার বেড়া সম্ভবত গৃহপালিত পশুর জন্যেই তৈরি করা হয়েছিল কখনো। শাহজাহান নিজের ঘোড়র পেটে গুতো দিয়ে লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। নিরাপদে বেড়ার মাঝে পৌঁছেই তাকিয়ে দেখতে পেলেন একদল শত্রু অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। এত দ্রুত কীভাবে অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে গেল তারা? অথবা নাকি বিজাপুরের সৈন্যরা জানতো যে তিনি আসবেন, তাই কামানের মত সশস্ত্র যোদ্ধাদেরও লুকিয়ে রেখেছিল একেবারে তৈরি অবস্থায়? এখন আর এসব ভাবার সময় নেই। যুদ্ধে মনোযোগ দিতে হবে। একেবারে সামনের শত্রু যোদ্ধা ডান হাতে লম্বা বল্লম নিয়ে সরাসরি তার দিকেই ছুটে আসছে।
শাহজাহান জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চেষ্টা করলেন এগিয়ে আসা সৈন্যেরা বামপাশে সরে যেতে, যেন বর্শা দিয়ে ঠিকমতো লাগাতে না পারে সম্রাটের গায়ে। লোকটা পার হয়ে যেতেই শাহজাহান তলোয়ার উন্মুক্ত করলেন। শত্রুঘোড়াকে আঘাত করতেই আরোহীকে ফেলে দিল মাটিতে। আরেকজন বিজাপুর সৈন্য চেষ্টা করল তলোয়ার দিয়ে আঘাত করতে, নিজের অস্ত্র দিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন সম্রাট।
নিজেদের ঘোড়া ছুটিয়ে আবারো একে অপরের দিকে ছুটে এলো দুজনে। ক্রমাগত বাড়ি দিয়ে ঘোড়াকে ছুটিয়ে নিয়ে আসছে।
এবার প্রথম আঘাত করলেন শাহজাহান, কিন্তু ঘাড় নিচু করে আঘাত এড়িয়ে তার দেহবর্মে পাল্টা আঘাত করল শত্রুসৈন্য। নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিল দেহবর্ম, কোন ক্ষতিই হল না। আবারো পরস্পরের দিকে ধেয়ে এলো দুজন। আবারো দ্রুত আঘাত করলেন শাহজাহান আর এবার মোক্ষম জায়গায় উদ্ধত তলোয়ার গিয়ে আঘাত করল শত্রুর অরক্ষিত চিবুকে, কণ্ঠনালি চিড়ে গেল। কোন চিৎকার না করেই ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেল মাটিতে।
তুলার কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ধোঁয়া আর ধুলার মাঝেই সমানে লড়ছে তাঁর দল। আরো শত্রুসৈন্য এসে যোগ দিচ্ছে দলে দলে, শাহজাহান স্বচক্ষে দেখলেন হ্রদের পেছনের গ্রাম থেকে এলো অনেকে। পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন যে বিজাপুরের সৈন্যরা তাঁর আগমন সম্পর্কে ধারণা করে সৈন্যদের লুকিয়ে রেখেছিল কুঁড়েঘরসহ যেখানে সেখানে সম্ভব সর্বত্র। আরো একবার শত্রুর ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছেন তিনি। আর এখন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেরি হবার পূর্বেই কিছু একটা করতে হবে।
এগিয়ে আসতে থাকা অশ্বরোহীদের মাঝে খুব বেশি হলে ডজনখানেক হবে এমন একদলের উপর চোখ পড়ল সম্রাটের। সবার প্রথমে দুজনে সৈন্য বহন করে আনছে সোনারঙা, বিজাপুরের পতাকা সর্পের জিহ্বার ন্যায় আকৃতি। এদের মাঝখানে প্রায় নিজের মতই চকচকে দেহবর্ম পরিহিত এক অশ্বারোহী। মাথায় পাখনাওয়ালা শিরস্ত্রাণ। এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বিজাপুরের সেনাপ্রধান আর যদি খবর সত্যি হয় তাহলে সুলতানের একাধিক পুত্রের একজন। যদি শাহজাহান একে হত্যা করতে পারেন তাহলে শত্রুদের অগ্রগতি ব্যাহত হবার পাশাপাশি মোগলরা শৃঙ্খলিত হবার সুযোগ পাবে।
তোমরা যে যে পারো আমার সাথে এসো। কাছাকাছি থাকা কয়েকজনকে ডেকে চিৎকার করে জানালেন ম্রাট। মোগল সৈন্যরা তাই করল, সকলে মিলে এগোতে লাগল বিজাপুরের সেনাপ্রধানের দিকে। বড়জোর ছয়শ গজ দূরত্ব দুই পক্ষের মাঝে। দ্রুত এগোতে লাগল শাহজাহানের ঘোড়া, ঘাড়ের কাছে সাদা ঘামের রেখা, কিন্তু তারপরও অন্যদের রেখে সামনে এগিয়ে গেল দ্রুত।
এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি পৌঁছে গেলেন বিজাপুরের সৈন্যদলের কাছে। প্রথম আঘাত করলেন পতাকাবাহক এক সৈন্যের অরক্ষিত বাম পায়ে। হাঁটুর ঠিক উপরে আঘাত করে হাড় পর্যন্ত কেটে ফেললেন মাংস। আরেকটু হলে শাহজাহানের অস্ত্রটাই পড়ে যাচ্ছিল। যাই হোক, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দেখতে পেলেন পতাকাবাহক পড়ে গিয়ে ধুলায় লুটিয়ে পড়ল সোনালি পতাকা। এ সময় আরেকজন অশ্বারোহী এসে আঘাত করল সম্রাটকে, কিন্তু বুকের বর্মে লেগে পিছলে গেল তলোয়ার। তবে ধাক্কা খেয়ে পিছনে হেলে গেলেন তিনি। আবারো নিজের ভারসাম্য ফিরে পেয়ে দেখতে পেলেন সেনাপ্রধানকে আঘাত করার মত যথেষ্ট নৈকট্য পেয়ে গেছেন। তাই সর্বশক্তি দিয়ে তলোয়ার চালালেন বিজাপুর সেনাপ্রধানের চকচকে বুকে বর্মের ঠিক নিচের অংশে। যদিও ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল, তারপরেও তলোয়ার ফেলে দিয়ে দুহাতে পেট চেপে ধরল লোকটা। তাড়াতাড়ি শাহজাহান আবারো তলোয়ার হাতে নিলেন শত্রু সৈনপ্রধানকে একেবারে শেষ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এই করতে গিয়ে নিজের মাথায় আঘাত অনুভবের সাথে সাথে শিরস্ত্রাণ পড়ে যেতে দেখলেন। দস্তানা পরা হাত উঠালেন। শিরস্ত্রান ঠিক করতে, কিন্তু কানে মনে হল তালা লেগে যাবার জোগাড়। চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে চোখের সামনে নাচতে দেখলেন সাদা তারার ঝলকানি। দৃষ্টিশক্তিও ঝাপসা হয়ে এল। এখনি রণক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে নিজের চেতনা ফিরে পাবার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।