কিন্তু এভাবে জনসমক্ষে যাওয়াটা আপনার জন্য ঝুঁকি হয়ে যাবে, তাই না? ভুলে যাবেন না যে অস্ত্র আর আহত হবার ভয় অন্যদের মত আপনারও আছে।
আমি জানি, আমি অন্য যে কোন মানুষের মতই মরণশীল। নিজেকে প্রকাশ করা হয়তো পাগলামীরই সামিল; কিন্তু এই ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে আমাদের রাজবংশ আর সাম্রাজ্যের জন্য।
পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মমতাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারলেন যে পত্নীর সন্দেহ এখনো দূর হয়নি, তাই শাহজাহান তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এছাড়া আমি নিজের খেয়াল রাখবো আর দেহরক্ষীরা তো থাকবেই। এই ফাঁকে সূর্যের শেষ রেশটুকুও মিলিয়ে গেল পশ্চিম দিগন্তে। নিচু হয়ে চুম্বন করলেন মমতাজকে। কতটা হারাতে হবে তাকে।
*
ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত শাহজাহানের দিকে এগিয়ে এলো রায় সিং। জাহাপনা…আমরা অতর্কিতভাবে আক্রমণ করেছি একদল বিজাপুর সৈন্যের উপরে। মধ্যাহ্নের খাবারের পর বিশ্রাম নিচ্ছিল লোকগুলো। কোন এক পশুপালকের পরিত্যক্ত কুড়ে ঘরে বসে সূর্যতাপ থেকে বাঁচতে ছায়ার কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে দুজন পালিয়ে গেছে–একজন যে ঘোড়াগুলো পাহারা দিচ্ছিল, আর দ্বিতীয়জন কোন একভাবে পালিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠে চলে যেতে সমর্থ হয়। কিন্তু বাকিদেরকে বন্দি করেছি আমরা–দেখুন, তারা আসছে।
বিকেলবেলার সূর্যের আলোয় তামার ঝকঝকানি থেকে চোখের উপর হাত রেখে শাহজাহান দেখতে পেলেন রায় সিংয়ের সাথে পাঠানো সৈন্যের দলকে-শিবিরের দিকে চলেছে সবাই। পাঁচজন ধরে রেখেছে ঘোড়াগুলোর লাগাম, এর সাথে চলেছে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা বন্দি সৈন্যের দল। চারজন বন্দির বয়স হবে তার নিজের বয়সের কাছাকাছি কিন্তু পঞ্চম জন বেশ তরুণ। লম্বা তরুণের কৃশকায় দেহে ঝুলছে ময়লা লাল সোনালি টিউনিক। বাকিদের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছে প্রহরীরা। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তরুণ।
তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলে রায় সিং? জানতে চাইলেন শাহজাহান।
হ্যাঁ, জাহাপনা। আমরা দুজন তাদেরকে একজন একজন করে কুঁড়েঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল প্রত্যেককে। আর আমার সঙ্গী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরস্কারের আশ্বাসও দিয়েছে। চারজন বেশ সাহসী, কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে; কিন্তু তরুণ সৈন্যরা ভয়ে পাজামা নষ্ট করে দিয়েছে যখন আমি ভয় দেখিয়েছি যে লোহার সাঁড়াশি গরম হচ্ছে তার পেট খুঁড়ে দেবার জন্য। একমাত্র সে-ই আমার সঙ্গীর নরম কথায় রাজি হয়েছে মুক্ত হবার বিনিময়ে যা জানে তা বলে দিবার জন্য। অন্য বিজাপুর সৈন্যরা সন্দেহ করেছে যে তরুণটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা এমনকি বিভিন্ন হুমিও দিয়েছে যে কি করবে তরুণের সাথে। এই কারণে তরুণকে আমরা পৃথক করে রেখেছি।
বেশ ভালো কাজ করেছো রায় সিং। কী বলেছে সে তোমাকে?
*
এগিয়ে চলো! গর্জন করে আদেশ দিলেন শাহজাহান। তিনি এবং তাঁর সৈন্যরা এগিয়ে যেতে লাগলেন দেড় মাইল দূরে অবস্থিত বিজাপুরের শিবিরের দিকে। তাঁবু বলতে এখানে আছে বেশ কয়েকটি হাতে বানানো আশ্রয়স্থান, যেগুলো নির্মিত হয়েছে আঠালো মাটির সাথে মড়া গাছের ডাল দিয়ে। কোন এক উপহৃদের অবশিষ্টাংশ এ জায়গা। এর থেকে বেশ খানিকটা দূরে কোন মতে এই খরার সময়েও টিকে আছে কয়েকটা কুঁড়েঘর, বোঝা গেল কোন এক সময় একটা গ্রাম ছিল সেখানে। বন্দি তরুণের কাছ থেকে শত্রু শিবিরের অবস্থান আর শক্তি সম্পর্কে জানতে পারার পর নিজের সেনাপতিদের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরে শাহজাহান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সূর্যোদয়ের ঠিক পরপরই আক্রমণ করার। এ সময় প্রাতঃকৃত্য আর প্রাতঃরাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে শত্রু সৈন্যরা।
চাঁদের আলোয় দীর্ঘপথ ঘোড়ায় চেপে আসতে আসতে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে, যেহেতু দুজন পালিয়ে গেছে, শত্রুপক্ষ কতটা সচেতন তাঁদের ব্যাপারে। যাই হোক, নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, যদি শত্রুরা পালিয়ে আসা দুজনের কথা মেনেও নেয় তারপরেও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারবে না যে শাহজাহান এত দ্রুত কোন পদক্ষেপ নেবেন। এছাড়া আক্রমণ আর তাঁবুর মাঝে ত্রিশ মাইল দূরত্ব এতটা দ্রুত অতিক্রম করবে ম্রাটের সৈন্যরা, এটাও তারা ভাবতে পারবে না।
কিন্তু অনর্থক বলে প্রমাণিত হবে এই ভয়, কেননা কয়েকটা ছোট পাহাড়ের উপর থেকে নিচে শত্রু শিবিরের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান ও তার সৈন্যরা দেখতে পেলেন রান্নার আগুনের ধোঁয়া, সারি বেঁধে থাকা ঘোড়া আর প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত শত্রু সৈন্যরা। পাহাড়ের চারপাশে পাহারারত কয়েকজন সৈন্যকে দ্রুত নাস্তানাবুদ করে ফেললো মোগল সৈন্যরা। টগবগ করে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি আর সৈন্যরা, বাতাসে উড়ছে সবুজ ব্যানার, কঠিন পোড়ামাটিতে ঝড় তুলছে ঘোড়ার খুর।
অন্যদিকে বিজাপুরের তাঁবুতে ঘোড়ার সারির দিকে ছুট লাগালো সৈন্যের দল, খাপমুক্ত করল তলোয়ার, পিরামিডের মত করে সাজিয়ে রাখা বর্শার সারি থেকে তুলে নিল যার যার অস্ত্র, প্রস্তুত হয়ে গেল মোগলদেরকে ঠেকাতে। কিন্তু যথেষ্ট সময় নেই তাদের হাতে। ভাবলেন শাহজাহান। আরো দ্রুত বেগে এগিয়ে চললেন নিজের ঘোড়া নিয়ে।
এরপর হঠাৎ করে সৈন্যের রণহুঙ্কার আর ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাপিয়েও শুনতে পেলেন ভারী পতনের শব্দ, একের পর এক। আওয়াজগুলো আসছে তার সামনের দিক আর বাম পাশ থেকে।