এক ঘণ্টা পরে, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে নিজের চারপাশে চক্রাকারে বসে থাকা সেনাপতিদের মুখোমুখি হলেন শাহজাহান। কেমন করে শত্রু আমাদেরকে একেবারে অন্ধকারে রেখে আক্রমণ করতে সফল হল? মধ্যম প্রহরী দলের নেতা আশোক সিংয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। আম্বারের রাজাদের পুত্রদের একজন এই তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সেনাপতি।
তারা আমাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখেছে, জাহাপনা। একজন বন্দি জানিয়েছে কেমন করে আমাদের সারির একটু সামনেই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল কয়েকজন শত্রুপক্ষের দল। পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসেছিল তারা–সাথে এমনকি বাড়তি ঘোড়াও নিয়ে এসেছিল লুটের মাল আর নিজেদের আহতদের নিয়ে যাবার জন্য। আর এভাবেই আমাদের মধ্যম ভাগ ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর সরাসরি পিছন থেকে আক্রমণ করেছে। আমাদের চলার পথে সৃষ্টি হওয়া ধুলার মেঘের সুবিধাটুকু নিয়েছে। ফলে একেবারে আমাদের উপর আঘাত হানার আগ পর্যন্ত কিছু বুঝতেই পারি নি আমরা।
মধ্যম ভাগে রক্ষী নিযুক্ত করে নি তুমি?
না জাহাপনা, আমি দুঃখিত।
তোমার উচিত ছিল। কিন্তু শুধু তোমাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এই ঘটনা থেকে আমাদের সকলেরই উচিত শিক্ষা নেয়া। শুধুমাত্র আরো বেশি রক্ষী নিযুক্ত করার প্রশ্নই নয়। আমাদের শত্রুদের চিন্তাধারা ও কৌশলও বুঝতে হবে। শুধুমাত্র মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কোন প্রত্যুত্তর এলো না সেনাপতিদের কাছ থেকে। শাহজাহান আবারো বলে চললেন, একত্রে আমরা সফল হবই। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু এখন ঠিক করতে হবে যে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। কতজন সৈন্য হারিয়েছি আমরা?
বেশি নয়–শত মানুষ থেকে কয়েকজন কম, আমার মনে হয়। কিন্তু রসদবাহী গাড়িতে আঘাত হওয়ায় প্রচুর মালামাল হারিয়েছি। বারুদ বোঝাই গাড়িতে, রসদবাহী গাড়িতে বিস্ফারণের ফলে বেশ কয়েকটি কামান বাঁধন ছেড়ে আলগা হয়ে গেছে আর খাদ্যের গাড়িতেও আগুন লেগে গেছে।
তো ঠিক আছে, বোরহানপুর ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই। সেখানে আমরা বিশ্রামের পাশপাশি পুনরায় রসদ জোগাড় করতে পারব। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন শাহজাহান। সভা শেষ করা হল।
সেনাপতিরা ফিরে যেতেই শাহজাহান ভাবলেন এরা প্রত্যেকেই বিশ্বস্ত আর ঘটনার ভয়াবহতাও ঠিক তার মতো করেই অনুভব করতে পেরেছে। কিন্তু এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদেরকে অবশ্যই–এর মাঝে তিনি নিজেও আছেন–আহমেদ আজিজের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শত্রুর ধূর্ততা আর শক্তিকে অবজ্ঞা করলে নিজেদের ধ্বংসই শুধু ডেকে আনবে তারা।
*
বোরহানপুরের পর্দা ঘেরা জানালায় একে অন্যের বাহুতে হাত রেখে দিগন্তে কমলা রঙের সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে আছেন শাহজাহান আর মমতাজ। দেখুন ওখানে কয়েকটা চিল উড়ছে। বলে উঠলেন সম্রাট পত্নী। ওখানকার সমভূমিতে নিশ্চয়ই কয়েকটা অবলা জন্তু মরে পড়ে আছে। মাথা নাড়লেন শাহজাহান। এই দৃশ্য বেশ স্বাভাবিক এখন। বর্ষাকাল এখনো আসেনি। সূর্যাস্তের আলোয় দেখা গেল গাছগুলোতে কোন উজ্জ্বলতা বা পাতার সমারোহ নেই। ঘাস প্রায় দেখাই যায় না, ফসলও তোলা শেষ। সবসময়কার চওড়া তাপ্তি নদী হয়ে গেছে থকথকে ঘোলাটে। মানুষ আর পশু যুদ্ধ করে নালা থেকে মূল্যবান পানি খুঁজে নিতে আর চারপাশের কয়েকটি সবুজ কর্দমাক্ত ডোবা ও এ কাজে। ব্যবহৃত হয়। গৃহপালিত-বন্য সব ধরনের পশুই মারা যাচ্ছে। শুকনো ভূমিতে পড়ে থাকছে মৃতদেহের শুকনো চামড়া আর হাড়।
চারপাশের গ্রামগুলো থেকে আসা সংবাদের মাধ্যমে জানা গেল যে। সেখানেও অকাতরে মানুষ মারা যাচ্ছে। বেশির ভাগই অনাহারে, অন্যরা গিয়েছে ক্ষুধার্ত বাঘের পেটে। খালি পেট ভরাবার জন্য জঙ্গল আর পবর্ত থেকে নেমে আসছে বাঘের দল। গ্রামের কিছু কিছু মানুষ কোটরে বসা চোখ আর হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে এসে পৌঁছাচ্ছে বোরহানপুরে। বাচ্চাগুলো মায়েদের দুধহীন, শুষ্ক স্তনে মুখ পুরে রেখেছে।
শাহাজাহান নির্দেশ দিলেন যেন সেনাবাহিনীর উদ্ধৃত্ত যোগান থেকে খাবার বিলি করা হয় এদের মাঝে; কিন্তু যেহেতু বিদ্রোহ এখনো শান্ত হয়নি, তাই সৈন্যরাই সবকিছুর প্রধান ভাগ পাবে। সম্ভবত পরিকল্পনামত আগামীকাল তিনি যে লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হবেন, তাতে সফল হলে শত্রুরা বাধ্য হবে তাঁর দাবি মেনে নিতে। কৌশল পরিবর্তন করে ভারী অস্ত্র আর পদাতিক বাহিনী রেখে ঘোড়সওয়ারদের ডিভিশন নিয়ে এগোবেন তিনি। ফলে দ্রুত এগিয়ে যাবে তাঁর প্রধান সারি আর শত্রুরা যতটা তৎপরতা দেখিয়েছে তেমনিভাবে আক্রমণে তিনিও সফলতা লাভ করবেন। তার চেয়েও বড় কথা, এই নতুন বাহিনীর গতির দ্রুততা কাজে লাগিয়ে ধরা পড়ার আগেই শক্রর কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন তিনি।
মনে হল যেন তার মনের কথা পড়তে পারছেন মমতাজ, এমনভাবে জানতে চাইলেন শাহজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে, আগামীকাল আপনাকেই কেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নিতে হবে? বেশির ভাগ সৈন্য তো এখানেই থাকবে আর আপনার যোগ্য সেনাপতিরও অভাব নেই। এ কাজে তাদের উপর কেন নির্ভর করছেন না?
হেসে ফেললেন সম্রাট। এই প্রশ্নটা তিনি নিজেও বেশ ভেবে দেখেছেন। তাই উত্তরটাও তৈরি ছিল। আমাকে যেতে হবে, কারণ তাহলে উদ্যম ফিরে পাবে আমার সৈন্যরা। এছাড়া গ্রামের লোকদের সামনে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমি। তাদের অনেকেই বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। কেননা তাদেরকে প্রচুর লাভের লোভ দেখিয়েছে তারা। আমি আমার দাদাজান আকবরের সোনার কাজ করা দেহবর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে যাবো। তিনি আমাকে সবসময় বলতেন যে একজন ম্রাটকে সবসময় সাধারণ মানুষের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হয়। এক্ষেত্রে ভাবমূর্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সাধারণ জনগণ তাদের ম্রাটকে বেশি ভালোবাসবে। সময়ের সাথে সাথে বারংবার নিজের উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছেন তিনি।