অধ্যায়–০৮
চিত্রকরদের মাঝে একমাত্র আমানত খানকে নিজের নাম তাজ-এর উপর স্বাক্ষর করার অনুমতি দিয়েছিলেন শাহজাহান। দুইটি স্থানে পরিস্ফুট হয়ে আছে এ স্বাক্ষর সমাধিস্থানের অন্তর্ভাগে দক্ষিণ খিলানের উপর আর এই খিলানের নিচের দিকে।
মোগল দরবারে আসা ইউরোপীয় দর্শনার্থীরা শাহজাহানের উন্মাদ যৌন আনন্দের কথা লিখে গেছেন, নিজের আবেগিক ক্ষতি মেটানোর জন্য শারীরিক আনন্দে মেতে উঠেছিলেন তিনি। ভেনেশীয় মানুচ্চি বর্ণনা করে গেছেন, মীনা বাজারে শাহজাহানের সুযোগ সৃষ্টির কথা : সেই আট দিনে প্রতিদিন দুবার করে স্টল পরিদর্শন করতেন সম্রাট বসতেন বহু তাতার রমণী বহনকৃত ছোট একটি সিংহাসনে, চারপাশে ঘিরে থাকত অসংখ্য তত্ত্ববধায়িকা, স্বর্ণের এনামেল করা লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটত তারা। আরো থাকত অসংখ্য নপুংসক, দর-কষাকষির কাজ করত; এছাড়া নারী সংগীতজ্ঞের দলও থাকত। দৃঢ় মনোযোগে পার হয়ে যেতেন শাহজাহান তাকিয়ে দেখতেন কোন বিক্রেতা তাঁর মনহরণ করে নিয়েছে কিনা। তাহলে সে দোকানে গিয়ে, ভাবে কথা বলে কিছু জিনিস নির্বাচন করে দিতেন। পাশাপাশি এও আদেশ দিতেন যেন যত মূল্য দাবি করবে তত মূল্যই যেন পরিশোধ করা হয়।
এরপর সম্রাট সম্মতিসূচক ইশারা দিয়ে চলে গেলে তত্ত্বাবধায়িকা, এই কাজে খুবই পটু, খেয়াল রাখত যেন নারীকে তারা পেয়ে যায়। আর সময় মত সেই নারীকে হাজির করা হত সম্রাটের কাছে।
অধ্যায়-০৯
শাহজাহান প্রকৃতই আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে নিজের রাজকীয় প্রতিনিধি আর শাহ সুজাকে বাংলাতে আর ওড়িষ্যাতে সুবেদার নিযুক্ত করেছিলেন।
১৬৪৪ সালের চৌঠা এপ্রিল এক ঘটনায় মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় জাহানরা। এ সম্পর্কে ইনায়েত খান লিখে গেছেন :
শাহজাদীর বুকের পোশাকের কিনার কক্ষের মাঝখানে জ্বলতে থাকা বাতির উপর দিয়ে চলে যায়। প্রাসাদের নারীরা যে পোশাক পড়ত তা তৈরি হত খুবই নাজুক কাপড় দিয়ে আর সুগন্ধি তেল মাখানো হত, তাই আগুন ধরার সাথে সাথে জ্বলন্ত শিখায় পরিণত হয় পুরো পোশাক। কাছাকাছি থাকা চারজন সেবাদাসী তৎক্ষণাৎ আগুন নিভানোর চেষ্টা করলে তাদের পোশাকেও ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ফলে তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যাওয়ায়, সতর্কঘণ্টা বাজার পূর্বেই, পানি ঢালার আগে, পিঠ, হাত আর শরীরের উভয় পাশ মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় এই অসাধারণ সুন্দরী নারীর। এটা আমার নিজস্ব ধারণা যে মদ আর আফিমের ঘোরে জাহানারাকে মমতাজ বলে ভুল করেছিলেন শাহজাহান। মোগল দরবারে আসা কয়েকজন বিদেশি শাহজাহান আর জাহানারার মধ্যে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের রটনা শুনেছেন বলে দাবি করেছেন। পিটার মান্ডি লিখে গেছেন :
মহান মোগলদের কন্যরা কখনো বিবাহ করতে পারত না…বাকিদের মাঝে শাহজাহান, চিমিনি বেগম (জাহানারা), অসম্ভব সুন্দরী বলে দাবি করেছেন অনেকেই, তার সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন (আগ্রাতে জনসমক্ষে সকলেই এই রটনা নিয়ে আলোচনা করত) কয়েক বারই দুজনকে একত্রে দেখা গেছে। যাই নিকোলাসও মানুচ্চি, যিনি কিনা রাজপরিবারের বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই রটনার গল্পকে বাজে কথা হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন যে জাহানারা অসম্ভব মমতা আর পরিশ্রম দিয়ে, পিতার দেখভাল করত, তাই–এ কারণেই সাধারণ মানুষ পিতার সাথে তার শারীরিক সম্পর্ককে ইশারা করে গালগল্প তৈরি করে। অন্যদিকে এ ব্যাপারে দাপ্তরিক উৎস সমূহ পুরোপুরি নিশুপ ছিল।
অধ্যায়–১০
প্রকৃতই একজন ফরাসী ডাক্তার লিখে গেছেন যে হাতের মাঝে রত্ন পাথরের দড়ি পেঁচিয়ে থাকায় রোগীর নাড়ি খুঁজে পাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব ছিল।
অধ্যায়-১১
এক লাখ হচ্ছে একশত হাজার। সমসাময়িক অনেকেই তাজমহল নির্মাণে বিশাল ব্যয়ভার নিয়ে মন্তব্য করে গেছেন। অন্যদিকে শাহজাহানের মাহতাব বাগের কথা সকলেই ভুলে ছিল। পলির স্তরের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল এর সাঁকো আর মঞ্চগুলো। ১৯৯০ সালের দিকে পুরাতাত্ত্বিক গণ প্রমাণ উন্মোচন করেন যে এ উদ্যান তাজমহল ভবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে বাগানগুলোকে পুনরায় সৃষ্টি করা হয়েছে। সংরক্ষণবাদীরা ১০,০০০ গাছ আর গুল্ম ঝাড় রোপন করে, এর মাঝে কড়া সুগন্ধঅলা সাদা চম্পা ফুলও রয়েছে– ম্যাগনোলিয়া জাতের সদস্য যেটি কিনা রাতে ফোটে ফুলের বেডগুলোতে আবারো শোভা বর্ধন করছে অত্যন্ত রঙিন গাঁদা, পানশি, নাস্টারটিয়াম প্রভৃতি ফুলের দ্বারা।
দারার নতুন প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে যেতে আওরঙ্গজেবের অস্বীকৃতির সংবাদ দিয়েছে একজন সভাসদ। বিভিন্ন উৎসগুলোও এ ব্যাপারে একমত যে জাহানারার আগুন লাগার ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন বাক বিতণ্ডার মাধ্যমে পিতার অনুগ্রহ লাভ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে আওরঙ্গজেব, পিতা-পুত্রের সম্পর্কেও চিড় ধরে। তির্যকভাবে লাহোরি লিখে গেছেন যে আওরঙ্গজেব অসৎসঙ্গ ও সংকীর্ণমনা সঙ্গীদের খপ্পরে পড়েছিল। এর কয়েক বছর পরে আওঙ্গজেব জাহানারার কাছে এক পত্রে এ সম্পর্কে আরো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশা তুলে ধরে। যেখানে আওরঙ্গজেব লিখেছিল যে, আমি জানতাম যে আমার জীবনকে লক্ষ্য করা হয়েছে (শত্রদের উদ্দেশ্যে); পরিষ্কার বোঝা যায় যে তার বিরুদ্ধে যে ব্যক্তিকে সন্দেহ করেছিল যে ছিল দারা, পিতার প্রিয়তম আর আওঙ্গজেবের চোখে ধর্মদ্রোহী। বিভিন্ন ঘটনাতেও এর স্বপক্ষে মত পাওয়া গেছে যে জাহানারা শাহজাহানের কাছে আওরঙ্গজেবের হয়ে মধ্যস্থতা করেছিল।