তাহাদের দুজনার মধ্যকার বন্ধুত্ব ও ঐকতান এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল যা কখনো কোন শাসক শ্রেণির স্বামী-স্ত্রী অথবা সাধারণ জনগণের মাঝে দেখা যায়নি। আর এটি শুধুমাত্র রক্ত-মাংসের শরীর সম্পর্কিত কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না, ছিল অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও আনন্দময় অভ্যাস, যার ভেতর এবং বাহির পুরোটাই পরিপূর্ণ ছিল শুভ আর যা কিছু ভালো তা দ্বারা। মহান এই ভালোবাসা, স্নেহ, সৌহার্দ্র প্রাচুর্য আর পরিপূরকতার কারণ ছিল উভয়ের মধ্যকার শারীরিক আর আত্মিক মেলবন্ধন।
শাহজাহানের শোকাতুর হৃদয়ের বিলাপ সম্পর্কে লেখা হয়েছে :
যদিও অতুলনীয় দাতা আমাদেরকে এতটা দিয়ে ভরে দিয়েছেন : তারপরেও যে ব্যক্তির সাথে এসব সহভাগিতা করতে চাই সে-ই চলে গেল।
মমতাজের মৃতদেহ আগ্রায় ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দারা ও জাহানারাকে দিয়েছিলেন শাহজাহান। একজন দরবার কবি এ উপলক্ষ্যে লিখে গেছেন, বেদনার নীল ঘেঁয়ে ফেলেছিল পুরো ভূমিকে।
অধ্যায় ০৬
তাজমহলের স্থাপত্য নকশার কৃতিত্ব নিয়ে দাবি উঠেছে বহু পক্ষ থেকে। কিন্তু সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রার্থী সম্ভবত উস্তাদ আহমাদ লাহোরি। ১৯৩০ সালের দিকে একজন গবেষক আবিষ্কার করেছেন অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে লাহোরি পুত্রের লেখা একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি। সেখানে লাহোরিকে দিল্লির লাল দুর্গ ও তাজমহলের স্থাপত্যবিদ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। ঘটনা যাই থাক না কেন, শাহজাহানের জীবনী রচয়িতাগণ উল্লেখ করে গেছেন যে ম্রাট নিজে নকশার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। স্থাপত্যের ব্যাপারে অত্যন্ত উঁচু সমঝদার ছিলেন শাহজাহান যে কারণে, তাঁর তরুণ বয়সে, পিতা জাহাঙ্গীর তাকে প্রশংসা করে গেছেন। ইংরেজি শব্দ প্যারাডাইস এর সহজ অনুবাদটি নেয়া হয়েছে পুরাতন ফারসী শব্দ পারিডেজা থেকে, অর্থ দেয়াল ঘেরা উদ্যান। উদ্যান আর অন্তহীন কবিতার একটি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টান এবং ইসলাম উভয়ের মাঝে, যেহেতু ওল্ড টেস্টামেন্ট আর মধ্যপ্রাচ্যেই উভয়ের শিকড় প্রোথিত। দ্য বুক অব জোনোসিস-এ লেখা আছে : ..উদ্যানে পানি দেয়ার জন্য এডেন থেকে প্রবাহিত হয়েছে একটি নদী আর সেখান থেকেই বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে চারটি মাথার।
তাজমহলের জন্য যে জায়গা নির্বাচন করেছেন শাহজাহান তা আগ্রা দুর্গ থেকে দেড় মাইল দূরে। আগ্রা দুর্গের কাছে নদীতে ডান হাতি তীব্র বাকের মুখে নিম্ন অববাহিকাতে অবস্থিত, ফলে যমুনা এখানে এসে খানিকটা দুর্বল হয়ে গেছে। আম্বারের রাজা ছিলেন এর মালিক যিনি কিনা আনন্দচিত্তে সম্রাটকে প্রদান করেন এ ভূমি। যাই হোক, ইসলাম ঐতিহ্যে মমতাজ মহলের মত নারী, যারা কিনা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাঁরা শহীদ আর তাই তাদের সমাধিস্থান তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত হবে। ঐতিহ্য আরো দাবি করে যে এক্ষেত্রে কোন ধরনের পীড়নমূলক উপাদান থাকতে পারবে না–সত্যি হোক না হোক–এহেন পবিত্র ভূমির স্থান নির্বাচনে। আর তাই শাহজাহান রাজাকে একটি নয়– চারটি পৃথক সম্পত্তি দিয়ে গেছেন এ জায়গার বিনিময়ে। এছাড়াও আম্বারের রাজা নিজ খনি মাকরানা থেকে মার্বেল সরবরাহ করেছেন শাহজাহানকে।
অধ্যায়-০৭
১৬৩২ সালের জুন মাসে আগ্রায় ফিরে আসেন শাহজাহান যেন ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতে পারেন তাজমহল নির্মাণের কাজ। ইংরেজ পিটার মান্ডি সম্রাজ্ঞীবিহীন রাজকীয় সরবরাহের প্রত্যাবর্তন চাক্ষুষ করে লিখে গেছেন, এটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর একটি প্রদর্শনী।
লাহোরির মতে, ১৬৩২ সালের জানুয়ারিতে তাজমহল সাইটে কাজ শুরু হয়। তখনো শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে ছিলেন। তাজমহলের খোদাইকৃত রত্ন সদৃশ্য নকশা বিস্মিত করে তুলেছিল সমসাময়িকদেরকে।
একজন দরবার কবি লিখে গেছেন : মার্বেলের উপর তারা এত সুন্দর করে পাথরের ফুল স্থাপন করেছেন যে সুগন্ধের দিক থেকে না হলেও রঙের দিকে থেকে সেগুলো ছাড়িয়ে গেছে আসল ফুলকে। রত্ন বিশেষজ্ঞ হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে চল্লিশটিরও উপরে ভিন্ন জাতের রত্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মাঝে বেশির ভাগই শাহজাহান নিজে পছন্দ করে দিয়েছেন। ফরাসী গহনাকার জ্যা-ব্যাপ্টিস্ট ভারনিয়ার, সম্রাটের রত্ন জ্ঞান দেখে অভিভূত হয়ে গেছেন। লিখে গেছেন যে, মহান মোগল রাজ্যে পাথর সম্পর্কে এতটা অসাধারণ জ্ঞান আর কারো ছিল না। তাজমহলের নির্মাণ কাজ করা কারিগরেরা পাথরের উপর নিজেদের চিহ্ন খোদাই করে রেখে গেছেন। ভারত পুরাতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর আড়াইশোর বেশি চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন তারা, চতুর্ভুজ, তীর আর এমনকি পদ্মফুল। শাহজাহানের তাজমহল নির্মাণ সম্পর্কিত ও পৃথিবীর মাঝে তিনি যে স্বর্গ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন সেটির পুরো ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ আর তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে পড়ুন অ্যা টিয়ারড্রপ অন দ্য চিক্ অব টাইম নামে ডায়ানা অ্যান্ড মাইকেল প্রিস্টনের নন-ফিকশন গ্রন্থটি।
দারা শুকোহর বিবাহের আংশিক বর্ণনা নেয়া হয়েছে লাহোরির বাদশানামা থেকে–শুকোহর এটি শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথম দশকে আঁকা চুয়াল্লিশটি চিত্রকর্মের একটি, যেগুলো সংরক্ষিত আছে। রয়্যাল লাইব্রেরি অব উইন্ডসর ক্যাসেলে।
….হাতির যুদ্ধ যেখানে নিজের শীতল সাহস তুলে ধরেছিল আওরঙ্গজেব তা একটি সত্যি ঘটনা।