ঘোড়ায় উঠে পড় সকলে। চিৎকার করে নির্দেশ দিল নিকোলাস। যত দ্রুত সম্ভব আগ্রায় পৌঁছাতে হবে।
৩. ঐতিহাসিক সূত্র
পিতা জাহাঙ্গীরের মত শাহজাহান নিজের কোন স্মৃতিকথা লিখে রেখে যাননি, কিন্তু তাঁর ঘটনাবহুল জীবন সম্পর্কে বিশদ ব্যাখা পাওয়া গেছে বিভিন্ন লেখকের রচনাতে। জাহাঙ্গীর নিজে তরুণ শাহজাহানের একটি চিত্র দিয়ে গেছেন–অথবা সে সময় অনুযায়ী শাহজাদা খুবরম যখন তরুণ বয়সে পিতার প্রিয়পাত্র ছিলেন। যখন জাহাঙ্গীর দুর্বল হয়ে পড়ে নিয়মিত লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, এ দায়িত্ব নিয়ে দেয়া হয় মুতামিদ খানের উপর যে পিতার বিরুদ্ধে শাহজাহানের বিদ্রোহকে তুলে ধরেছে। সম্রাট হিসেবে রাজত্ব শুরু করার পর শাহজাহান আবদুল হামিদ লাহোরীকে দায়িত্ব দেন নিজের শাসনামল লিপিবদ্ধ করার জন্য। কিন্তু প্রতিনিয়ত দুর্বলতার শিকার হয়ে লাহোরী শাহজাহানের রাজত্বকালের কেবলমাত্র প্রথম পঁচিশ বছর তুলে ধরেছেন তাঁর বাদশা-নামাতে। যাই হোক, তাজমহল নির্মাণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে গেছেন লাহোরী। এ ছাড়াও, পণ্ডিত ইনায়েত খান, রাজকীয় পাঠাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি শাহজাহানের শাসনামলের বিস্তারিত বর্ণনা লিখে গেছেন, শাহজাহাননামা নামক গ্রন্থে। এর পাশাপাশি দরবারের বিভিন্ন লেখা তো রয়েছেই।
বিদেশীরাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে গেছে। লিখে রেখে গেছে মোগল দরবারে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সম্পত্তি আর প্রাচুর্য দেখে বিস্ময়ের কথা। ইংরেজ পিটার মান্ডি, ভারতে থেকেছেন ১৬২৮ থেকে ১৬৩৩। তাজমহলের প্রথম দিককার নির্মাণ কাজ দেখেছেন। লিখে গেছেন : এই ইমারত… নির্মাণের ব্যয় হচ্ছে অসম্ভব শ্রম এবং অর্থ, তত্ত্বাবধান করা হয় অসাধারণ অধ্যবসায় বজায় রেখে। সোনা, রুপা সাধারণ উপাদান হলেও মার্বেল আর সাধারণ পাথর দিয়ে হলেও ফুটে উঠেছে অত্যাশ্চর্যভাবে। ভেনেশীয় অভিযাত্রী নিকোলাও মানুচ্চী শাহজাহানের পরিবারের সংঘর্ষ আর ভাঙন দেখেছেন স্বচক্ষে। তাঁর স্টোরিয়া দো নোগর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন কীভাবে দারা শুকোহ্র হয়ে যুদ্ধ করেছেন আর শেষ ময়দান সামুগড়ের চিত্রও তুলে ধরেছেন নিপুণ হস্তে।
তারপরেও সবসময়কার মত উৎসগুলোকে নাড়াচাড়া করতে হয় সাবধানে। বেতনভুক্ত জীবনীকারেরা কাজের ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতেন। কেননা তাদের লেখনীর ক্ষেত্রে প্রশংসার চেষ্টা আর সংঘবদ্ধ প্রচারণা করার উদ্দেশ্য থাকত। কিন্তু মোগল দরবারে বেড়াতে আসা বিদেশীরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত। তবে এ ব্যাপারে অতি মাত্রায় আগ্রহ আর স্থানীয় প্রথা ভাষা সম্পর্কে না জানা থাকাতে অনেক কিছুকেই তারা আবার অবহেলাও করত আর সত্যিকারের ঘটনা প্রবাহ বুঝতে অসমর্থ হত। এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া একটি তথ্যের ক্ষেত্রে কারো কোন সন্দেহের অবকাশ নেই আর তা হল শাহজাহান ও মমতাজের মাঝে অবিচ্ছিন্ন বন্ধন, পত্নীর মৃত্যুর পর সম্রাটের ভেঙে পড়া, মমতাজ এবং শাহজাহানের জীবিত ছেলেমেয়েদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হওয়া; বহু পরে শাহজাহান নিজে এসব আবিষ্কার করলেও তখন আর কিছুই করার ছিল না।
এই সিরিজের প্রথম গ্রন্থগুলোর মতই, প্রধান চরিত্রদের প্রায় সবগুলোই বাস্তব জীবনেও ছিলেন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে রাজকীয় মোঘল পরিবার রাজপুত শাসকেরা মোগলদের অত্যন্ত কাছের বিশ্বাসভাজনে যেমন সাত্তি আল-নিসা। যদিও কয়েকটি চরিত্রকে যেমন নিকোলাস ব্যালান্টাইন যিনি নিজের প্রথম আগমন ঘটিয়েছিলেন দ্য টেইন্টেড থ্রোন-তে, সৃষ্টি করা হয়েছে অন্য কারো অনুকরণে, এক্ষেত্রে নিকোলাও মানুচী আর রাজপুত শাহজাদা অশোক সিংয়ের চরিত্রটাও সেরকম। প্রধান ঘটনা আর যুদ্ধ সমূহ সত্যিকারেই সংঘটিত হয়েছিল; যদিও বর্ণনা করার সুবিধার্থে সময়গুলোকে কখনো-সখনো খানিকটা পরিবর্তন করেছি। এছাড়া কিছু ঘটনাকে এড়িয়েও গেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর মহান আর বিশাল রাজবংশের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকেই গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা।
গবেষণার জন্য অনেক জায়গাই টেনে নিয়ে গেছে আমাকে। যেখানে ফুটে আছে শাহজাহান আর মমতাজের ভালোবাসার কথা, ট্রাজেডির কথা যা কিনা পরবর্তী প্রজন্মেই নড়বড়ে করে দেয় রাজপরিবারের ভিত। দক্ষিণে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে শাহজাহান আর মমতাজের সর্বশেষ ভ্রমণ পথটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। যে পথ ধরে তারা একসাথে গিয়েছিলেন তাপ্তি নদীর ধারে বোরহানপুরের অভিশপ্ত সেই প্রাসাদে। এখানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব জরিপ অফিসের কর্মচারি আমাকে দেখিয়েছে যে কক্ষে মমতাজ মারা গেছেন বলে সকলের বিশ্বাস, সেই কক্ষ। নদীর ওপাড়ে, চারপাশে ক্ষেত, জায়নাবাদ উদ্যান খুঁজে পেয়েছি আমি। জায়গাটা মোগলদের পুরোন শিকার স্থান এখানে এখনো টিকে আছে বারদারি মঞ্চ যার নিচে মমতাজের মৃতদেহ অস্থায়ী ভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
আগ্রা দুর্গ, যেখানে সম্রাজ্ঞি হিসেবে নিজের জীবনের খানিকটা সময় কাটিয়ে গেছেন মমতাজ, এখনো বহন করছে। রাজপরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের চিহ্ন, মার্বেলের স্নানঘর হাম্মাম, যেখানে বয়ে চলেছে গোলাপের পানি আর তৈজসপত্র, বহু স্তম্ভঅলা ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের কামড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে শাহজাহানের কথা, রত্নপাথরে সজ্জিত, ন্যায়বিচারের বর্ষণ করছেন প্রজাদের উপর অন্যদিকে একইভাবে জ্বলজ্বলে মমতাজ তাকিয়ে আছেন পেছনের খোদাই করা পর্দার ফাঁক দিয়ে। দুর্গের মার্বেলের বারান্দাগুলোতে যমুনা নদী দেখার জন্য নির্মাণ করেছিলেন শাহজাহান, ভাগ্যক্রমে যেটি তাঁরই কারাকক্ষে পরিণত হয়। সাদা মার্বেলের উপর খোদাই করা ফুলগুলোর রং এখনও ঠিক সেরকমই পরিষ্কার আর উজ্জ্বল রয়েছে যেমনটা পাথরের উপরে পাতা আর পাপড়িগুলো তৈরি করেছিলেন কারিগররা। তাই মার্বেলের মেঝে আর পিলারগুলো স্পর্শ করলেই অন্য রকম একটা অনুভূতির স্বাদ পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে মনোহর হচ্ছে ব্রোঞ্জের চাদোয়া সমেত অষ্টভুজ টাওয়ার, এখানে মেঝের ঠিক মাঝখানে আছে মার্বেলের খোদাই করা একটি সাঁকো স্তম্ভ আর দেয়ালের মাঝে আছে আইরিস সহ অন্যান্য অসম্ভব দৃষ্টিনন্দন উজ্জ্বল সব লতানো ফুলের সমারোহ।