ঠিকই ভেবেছে সে। পুরো দলটা পার হয়ে গেল তার দিকে একবারও না তাকিয়ে, শুধুমাত্র একজন সবুজ পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী ঘোড়া সহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মৃত বিদ্রোহী সৈন্যের গায়ের উপর। দুমড়ে মুচড়ে ঘোড়ার পিঠের উপর থেকে বস্তার মত মাটিতে পড়ে গেল সৈন্যটা। আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসা সৈন্যরা পায়ের চাপে পিষ্ট করে ফেলল তাকে, এতটাই ভীত তারা যে সঙ্গীকে পাশ কাটানোর চিন্তাও মাথায় রইল না!
দারার উচিত এখনি এসে সবার সামনে দেখা দেয়া, নয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। শোধরানোর অযোগ্যভাবে পরাজয় ঘটবে যুদ্ধে আর আগ্রার রাস্তা খুলে যাবে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের জন্য।
ভালোভাবে যুদ্ধের মতিগতির দিকে তাকাতেই প্রায় দুইশ গজ দূরে হট্টগোলের মাঝে সাদা উজ্জ্বল চিহ্নঅলা কালো ঘোড়া দেখতে পেল নিকোলাস। প্রায় খোঁড়াতে লাগল ঘোড়াটা আর নিতম্বের কাছ থেকে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ তরল রক্ত, কিন্তু পিঠের উপরে থাকা আরোহীর কোন দেখা নেই। দারা নিশ্চয়ই আঘাত পেয়ে পড়ে আছে কোথাও। তাড়াতাড়ি করে ঘোড়া ছুটিয়ে সেই তেজী ঘোড়াটাকে প্রথম যেখানে দেখতে পেয়েছে সেদিকে ছুটে গেল নিকোলাস। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল সবুজ আর সোনালি পোশাক পরিহিত দারার তিনজন দেহরক্ষী ঘোড়ায় চেপেই আপ্রাণ চেষ্টা করছে সোনার দেহবর্ম পরে মাটিতে শুয়ে থাকা স্থবির দেহটাকে নিরাপত্তা দিয়ে ঢেকে রাখতে।
প্রায় সাথে সাথে কালো পোশাকের এক বিদ্রোহী অশ্বারোহী এসে ঘোড়ার উপর থেকে আঘাত করে ফেলে দিল দারার একজন দেহরক্ষীকে। এর মুহূর্তখানেকের মাঝে দ্বিতীয় দেহরক্ষী মুখ থুবড়ে পড়ল ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে, নির্ঘাৎ আহত হয়েছে। তৃতীয় জন একা লড়ে চলেছে চারজন বিদ্রোহী আক্রমণকারীর সাথে।
যত জোরে সম্ভব নিজের সব সৈন্যকে তার পিছু নিতে বলে খণ্ডযুদ্ধের দিকে এগোতে শুরু করল নিকোলাস। ভয় হচ্ছে পাছে দেরি না হয়ে যায়। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল নিজের পিস্তল দুটোর কথা। ভারী দস্তানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোমরের কাছ থেকে টেনে নিল একটি পিস্তল। ঘর্মাক্ত হাত বারবার পিছলে যাচ্ছে গোলাকার হাতলের উপরে, কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে বজ্রমুষ্টিতে আঁকড়ে ধরল পিস্তলের হাতল, নিশানা ঠিক করে গুলি ছুঁড়ে বসল, উপরের দিকে হাত তুলে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল এক বিদ্রোহী। কিন্তু নিকোলাস জানে যে এত দূর থেকে এ শট লাগাটাকে সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। অন্য আরেকটা পিস্তলে হাত দিতেই তলোয়ারের আঘাতে আরেকজন বিদ্রোহীকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিল দারার দেহরক্ষী।
দ্বিতীয় পিস্তলের নিশানা ঠিক করে বাকি দুজন বিদ্রোহী যোদ্ধার একজনের দিকে গুলি ছুড়ল নিকোলাস। কিন্তু গুলি করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল নিজের ঘোড়ার, ফলে আরোহীর গায়ে না লেগে গুলি গিয়ে লাগল ঘোড়ার নিতম্বে। ভীত হয়ে আহত ঘোড়াটা ডাক ছেড়ে দাপাদাপি শুরু করতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল বিদ্রোহী লোকটা। এলোমেলো দৌড়াতে শুরু করল ঘোড়া, কিন্তু খানিক দূর যেতেই আরোহীকে পেটের নিচে নিয়ে ভেঙেচুড়ে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়া, বাকি আছে আর একজন কিন্তু নিকোলাস তার কাছে এগিয়ে যেতেই বেঁচে থাকা তৃতীয় দেহরক্ষীকে তলোয়ারের আঘাতে মাটিতে ফেলে দিল বিদ্রোহী সেনা।
ততক্ষণে পৌঁছে গেল নিকোলাস। এবার তার দিকে উন্মত্তের মত আঘাত হানল বিদ্রোহী। কিন্তু নিকোলাসের হাতে এখনো পিস্তল, অস্ত্রটাকে ঘুরিয়ে ধরে কাকৃতি হাতল দিয়ে জোরে আঘাত করল বিদ্রোহী সৈন্যের মুখমণ্ডলের উপর। ফেনিল রক্ত আর দাঁতের ভাঙ্গা কণা এসে মিশে গেল লোকটার কালো দাড়িতে। ধাতস্থ হবার আগেই পিস্তল এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তলোয়ার হাতে নিল নিকোলাস, আঘাত করল শত্রুর ঘাড়ের উপর, শিরস্ত্রাণের ঠিক নিচে, ডোডো হয়ে গেল হাড় আর শ্বাসনালী। পড়ে গেল বিদ্রোহী সেনা।
এরই মাঝে নিকোলাসের নিজের সৈন্যরা আর দারার দেহরীক্ষরা এসে পৌঁছতেই ঘোড়র উপর থেকে লাফিয়ে নেমে দারার কাছে এগিয়ে গেল নিকোলাস। শাহজাদাকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি শরীর পরখ করে দেখল। কপালের কাছে ভেজা কাটা দাগ ছাড়া আর কোন বড় ক্ষতের দেখা মিলল না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালো যেন শুধুমাত্র সংজ্ঞা হারানোই হয় এটা। কোমরের কাছ থেকে পানির বোতল বের করে দারার চোখেমুখে কয়েক ফোঁটা ফেলতেই মনে হল নড়ে উঠল শাহজাদা। এরপর সাবধানে দারার মুখে মাঝেও খানিকটা পানি ঢালতেই কাশতে শুরু করল শাহজাদা।
বেঁচে আছে। চারপাশে ঘিরে থাকা সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস। যার কাছে আছে সবচেয়ে সেরা ঘোড়াটা, নেমে এসো, শাহজাদাকে চড়তে দাও। অন্য কারো ঘোড়ায় উঠে যাও। বাকি তিনজন দেহরক্ষীকে পরীক্ষা করে দেখো জীবনের আশা আছে কিনা। যদি থাকে তাদেরকেও ঘোড়র উপর তুলে নাও, যদি নিজেদের আসনের সাথে বেঁধে নিতে হয়, তাই নাও।
ছুঁড়ে ফেলে দেয়া পিস্তলটাকে তুলে নিয়ে কোমরের কাছে প্রথমটার সাথে রেখে দিয়ে চারপাশে তাকাল নিকোলাস। ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে যেদিকেই তাকাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে পিছু হটছে দারার সৈন্যরা। দ্রভাবে বলতে গেলে এটাই সমাপ্তি। বেশিরভাগই ছুটছে আপন প্রাণ বাঁচাতে। নিকোলাস ভালো করেই জানে যে এরকম অর্ধ-অচেতন দারাকে নিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার কোন সম্ভাবনাই নেই। শাহজাদার এখন একমাত্র আশা আগ্রাতে পৌঁছে হাকিমদের কাছে যাওয়া যেন বেঁচে থাকতে পারে আরেকটা যুদ্ধের জন্য।