দুই কি তিন মিনিটের মাথায় যুদ্ধের ময়দানের ঘন ধোঁয়ার ভেতরে ঢুকে গিয়ে জ্বালা করে উঠল নিকোলাসের চোখ আর নাক। একটু ফাঁক পেতেই দেখতে পেল তিন থেকে চারশ গজ দূরে থেমে আছে দারার হাতি। হাত আর পা দিয়ে সমানে তাগাদা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল এর কারণ। হাওদা থেকে নিচে নেমে আসছে দারা। আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই যুদ্ধের চিৎকার-চেঁচামেচি আর অস্ত্রের গর্জন ছাপিয়ে দারার দেহরক্ষীদের প্রধানের কাছে জানতে চাইল, কী ব্যাপার? শাহজাদা কেন নেমে যাচ্ছে? হাতি আহত হয়েছে?
না, হাতি ঠিকই আছে। শাহজাদা ঘোড়ায় চেপে আরো দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে খলিল উল্লাহ খান থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত ষড়যন্ত্রের জবাব দিতে।
এক কি দুই মিনিটের মাথায় কপালে সাদা রঙের উজ্জ্বল দাগঅলা একটা কালো তেজী ঘোড়ার উপর উঠে বসল দারা। এগিয়ে গেল বাম দিকের যুদ্ধের মাঝে, পেছনে গেল দেহরক্ষীদের দল, নিকোলাস আর তার সৈন্যরা। মাহুতকে রেখে গেল রাজকীয় হাতিকে শূন্য হাওদা সহ দারার শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
একটু পরেই দারা, নিকোলাস আর তাদের অনুসরণকারীরা এগিয়ে গেল রণ-সাজে সজ্জিত বিদ্রোহী সৈন্যদের দিকে। তীরের মত করে আশেপাশের সৈন্যদেরকে কচুকাটা করতে করতে এগিয়ে আসছে দারাদের দিকে। নিজের লম্বা দ্বি-ফলা তলোয়ার বের করে পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাবার সময় এক বিদ্রোহী সৈন্যের দিকে আঘাত করল নিকোলাস। নিজের তলোয়ার দিয়ে নিকোলাসের আঘাত ঠেকিয়ে দিল সৈন্যটা আর একই সাথে নিজের ভোজালি দিয়ে আঘাত করতে চাইল নিকোলাসকে। ঘোড়ার পিঠে বসে ঘুরে গেল নিকোলাস, নাকের সামনে দিয়ে বাতাস কেটে বের হয়ে গেল বিদ্রোহী সেনার খঙ্গ। প্রায় সাথে সাথে নিজের চঞ্চল দ্রুত ঘোড়াকেও ঘুরিয়ে নিল বিদ্রোহী লোকটা টাটু ঘোড়ার চেয়ে একটু বড়। আরো একবার আঘাত করতে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে প্রথম বার আঘাতের ধাক্কায় এখনো বেসামাল হয়ে আছে দারার ইংরেজ সেনাপ্রধান।
নিকোলাসের এই অবস্থা দেখে আর প্রতিপক্ষকে খতম করে দেয়ার আশায় বিদ্রোহী সৈন্যটা সাবধানে হাত মাথার পিছনে নিয়ে চাইল সর্বশক্তি দিয়ে খড় তুলে নিকোলাসের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে। এই ফাঁকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে নিজ তলোয়ারের অসম্ভব লম্বা দৈর্ঘ্যকে কাজে লাগিয়ে নিকোলাস অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল বিদ্রোহী সেনার অরক্ষিত বগলে। চিৎকার করে উঠে একপাশে সরে গিয়ে হাতের খঙ্গ মাটিতে ফেলে দিল লোকটা। দ্বিতীয় আরেক বিদ্রোহী সেনা বর্শা বাগিয়ে ধরে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে। কিন্তু নিকোলাসের শক্ত ইস্পাতের দেহবর্মে লেগে পিছলে গেল বর্শার ফলা আর তড়িঘড়ি করে লোকটার হাতের উপরের দিকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল নিকোলাস। চিৎকার করে কেঁপে উঠল দ্বিতীয় বিদ্রোহী সেনা, ছুঁড়ে ফেলে দিল অকম বর্শাটা, ক্ষত থেকে হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল রক্ত।
চারপাশে তাকিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল দারার দেহরক্ষীরা আর তার নিজের ভাড়াটে সৈন্যটা শক্তভাবে প্রতিহত করছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সৈন্যদের, যাদের বেশির ভাগই পড়ে রইল আহত বা মৃত হয়ে। কিন্তু নিকোলাসের সৈন্যদের মাঝেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। বহু বছর ধরে তার সাথে কাজ করা একজন বুন্ডিয়ান নিজের রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে মাটিতে, আদারঙা চুলে জড়িয়ে আছে ছিন্নভিন্ন মগজ আর খুলি ফেটে বেরিয়ে আসছে তরল।
আবারো যুদ্ধে এগিয়ে যেতে উদ্যত হল নিকোলাস। সহযোদ্ধার হয়ে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর এখন সে, বিদ্রোহী সেনাদের কারণে যাকে প্রাণ দিতে হল। যুদ্ধের সমস্ত শোরগোল ছাপিয়েও শুনতে পেল পেছনে এগিয়ে আসছে অসংখ্য খুরের শব্দ। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল, সবুজ ব্যানার উড়িয়ে বন্য উন্মত্তে ছুটতে ছুটতে আসছে একদল অশ্বারোহী। নিঃসন্দেহে দারার সৈন্য।– একেবারে সামনের জনের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস, কেন পিছু হটছো তোমরা? প্রথম কয়েকজন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই বিচলিত যে উত্তর দেবারও সময় হলনা তাদের; কিন্তু কিশোর অবস্থার থেকে একটু বড় হবে বয়সে এমন একজন অশ্বারোহী এক মুহূর্তের জন্য টেনে ধরল ঘোড়ার লাগাম। শাহজাদা দারা পালিয়ে যাচ্ছে, তাই আমরাও। নিজের জীবনের মায়া থাকলে তুমিও তাই কর।
কিন্তু শাহজাদা তো পালিয়ে যায়নি। পাল্টা চিৎকার করে উত্তর দিল নিকোলাস।
ভুল করছ তুমি। রাজকীয় হাতিকে পেছন দিকে চলে যেতে দেখেছি। কিন্তু হাওদা যে খালি তা দেখোনি?
না। কিন্তু তার মানে তো শাহজাদা নিশ্চয় মৃত।এই কথা বলে নিকোলাসকে আর একটিও শব্দ করার সুযোগ না দিয়ে ঘোড়র পেটে পা দিয়ে গুতো মেরে নিজের সঙ্গীদের পিছু নিল তরুণ। চারপাশে তাকিয়ে দারাকে খুঁজল নিকোলাস। কিন্তু ভিড়ের চাপে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। এমনকি সামনের দিকে চোখ মেলেও কিছু না পেয়ে পেছনে ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দ শুনতে পেল। আরো একবার ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল তার নিজের পাশ থেকে সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে সামনে দিকে।
শাহজাদা দারা নিরাপদ আছে! আমরা যুদ্ধ জিততে চলেছি! চিৎকার করে আশেপাশের যোদ্ধাদেরকে জানাতে চাইল নিকোলাস, কিন্তু জানে যে যদি সেও এ অবস্থায় পড়ত, মন দিয়ে শোনার পর্যায়ে থাকত না।