যুদ্ধে উন্মাদনায় ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়ে, শাহজাহান প্রথমেই ভাবলেন পিছু ধাওয়া করে এই ছোট্ট দলটাকে নিঃশেষ করে দেবেন, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন যে এমন করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেনাপ্রধান হিসেবে এ দায়িত্ব অন্যদের উপর দিলেন। বরঞ্চ প্রধান সারির মাঝখানে গিয়ে দেখা দরকার যে কী অবস্থা, সেখান থেকেই মূলত এর উৎপত্তি।
ধোঁয়া আর ধুলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলেন নিজের অসংখ্য সৈন্য মাটিতে স্থির হয়ে পড়ে আছে। সাথে আছে বেশ কয়েকটি ঘোড়া আর একটা যুদ্ধহাতির মৃতদেহ। আরেকটা ঘোড়ার বাম পা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও কোনমতে দাঁড়িয়ে কাতর আর্তনাদ করছে। যাই হোক, মাঝ বরাবার যেতেই যুদ্ধের তেমন কোন চিহ্ন দেখতে পেলেন না; এখানে রসদ আর বারুদের গাড়ি রয়েছে।
চারপাশে কালো ধোঁয়ায় ঘন মেঘের মত সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্য দিয়েই কোনমতে শাহজাহান দেখতে পেলেন কয়েকটা ছয় চাকার গরুর গাড়ি ইতস্তত ঘুরছে। প্রথম গাড়িটা টানছিল এমন দুটি গরু আহত হয়ে গিয়েছে। চালকেরা চেষ্টা করছে রশি কেটে মুক্ত করে দিতে, পেছনে চিৎকার করছে অন্য রসদবাহী গরু আর চালকেরা। ঠিক সেই মুহূর্তেই সম্রাট দেখতে পেলেন আগাগোড়া কালো পোশাকে মোড়া ছয়জন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে গরুগাড়িগুলির দিকে। প্রত্যেকের হাতে দুইটি করে ধনুক, সাথে আরো একজনের হাতে ধরা তীরের মাথায় জ্বলন্ত ভেজা ন্যাকড়া। ঠিক এই কৌশলেই হত্যা করা হয়েছে আবদুল আজিজের পিতা আহমেদ আজিজকে।
ধনুকে জ্বলন্ত তীর লাগানোর আগেই কিছু একটা ভাবতে হবে, বুঝতে পারলেন শাহজাহান। ঘোড়র পাদানিতে দাঁড়িয়ে ধনুকে তীর লাগিয়ে তৈরি হয়ে নিল লোকগুলো রসদবাহী গাড়িতে আগুন লাগানোর জন্য। চালকেরা এতক্ষণে প্রথম গরুগাড়ি থেকে আহত গরুকে রশি কেটে মুক্ত করতে পেরেছে। একটা বন্দুকের গুলি গিয়ে আঘাত করল কালো পোশাকধারী ধনুচিদের দিকে, নিজের তীর ছোঁড়ার আগেই পড়ে গেল লোকটা। আর এই কারণে জ্বলন্ত তীর থেকে নিজের কাপড়েই আগুন ধরে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে, মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল লোকটা।
এরপর গরম বাতাসের হলকা ধেয়ে এলো শাহজাহানের দিকে। বধির করে দিয়ে প্রায় জিনের উপর থেকেও ফেলে দিচ্ছিল আরেকটু হলে। নিজের ঘোড়াকে থামানোর চেষ্টা করতে করতে ভাবতে লাগলেন কী ঘটেছে। বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই গাড়ি ভর্তি বারুদ ছিল। অন্তত একজন ঘোড়সওয়ারের তেল লাগান ন্যাকড়া গিয়ে ভেতরে থাকা বারুদের বস্তায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘোড়াকে শান্ত করতে পারলেও বাম গালে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। দস্তানা খুলে আঙুল দিয়ে ব্যথার জায়গায় পরীক্ষা করে আবিষ্কার কললেন ছোট্ট কাঠের টুকরো। বালুকণা আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চোখে নিচে তাকিয়ে দেখলেন ঘোড়ার পার্শ্বদেশে আর জিনের গায়েও অসংখ্য স্প্রিন্টার ঢুকেছে। তার মতই সবকিছুর গায়ে লাল রঙের আঠালো কী যেন লেগে রয়েছে–গাভী আর চালাকের মৃতদেহের মাংস। ধুলা একটু কমতেই দেখতে পেলেন বিস্ফোরিত হয়েছে দুটি গাড়ি। চারপাশে ছড়িয়ে আছে মনুষ্য দেহের থেতলানো মাংসপিণ্ড, কোন কোন টুকরার গায়ে এখনো লেগে আছে কাপড়ের অবশিষ্টাংশ, একসাথে দলা পাকিয়ে গেছে গরু আর গাড়ির দেহাবশেষের সাথে পোড়া মাংসের গন্ধের সাথে মিশে গেছে ঝাঁঝালো বারুদের গন্ধ।
একজন সেনাপতিকে উঠে দাঁড়াতে দেখলেন শাহজাহান। দেখতে পেলেন তার ঠোঁট নড়ছে, বুঝতে পারলেন যে লোকটা কিছু একটা বলছে, কিন্তু শুনতে পেলেন না কিছুই। তবে খুব শীঘ্রিই শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়ে বুঝতে পারলেন সেনাপতির কথা, তারা পালিয়ে যাচ্ছে জাহাপনা বিস্ফোরণের ফলে আচ্ছন্ন চেতনাতেও শাহজাহান জানেন যে পালিয়ে যাওয়া শব্দটি সঠিক হল না। তিনি তো তাঁর শত্রুদের পরাজিত করতে পারেননি। সফলভাবে তাঁর সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করে কৌশলগতভাবে পিছু হটছে তারা। মোগলরা নয়–তারাই আজকের বিজয়ী।
কিন্তু এভাবে হবার কথা নয়…কেননা সম্ভবনাকে সত্যি প্রমাণিত করে উদ্ধত স্বভাবের গোলকুন্ডা সৈন্যরা বিজাপুরের সৈন্যদেরকে রেখে নিজেদের ভূ-খণ্ডে ফিরে গেছে, যুদ্ধ এখন বিজাপুরকে একাই লড়তে হবে। এতটা তো শাহজাহান কখনো ভাবেননি যখন এক মাস আগে বোরহানপুর থেকে প্রধান সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাপ্তি নদীর তীরে আক্রমণকারীদের দলকে প্রতিহত করার জন্য, যারা দুর্গ সমূহে অতর্কিত বিচ্ছিন্ন হানা দিয়ে হত্যা করেছে তাঁর কসিড, বার্তাবাহক আর কর সংগ্রাহকদেরকে। বস্তুত বেশ কয়েকটি ব্যাপারেই বেশ অবাক হয়েছেন তিনি। যেমন, তাঁর সৈন্যরা বন্দি করতে পেরেছে এমন আক্রমণকারীদের মাঝে আছে স্থানীয় জনগণরাও। জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে ষড়যন্ত্রে নিজেদের অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে নানা অজুহাত তৈরি করছে লোকগুলো; কেউ দাবি করছে এই ভীষণ দুর্ভিক্ষে খাদ্যের সংস্থানের জন্য শত্রুপক্ষ যোগ দিয়েছে তারা। অন্যরা অনুনয় করে বলছে যে সম্রাটের বিশাল সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণের জন্যে আরোপিত কর দিতে গিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।
কিন্তু সম্রাটের হাতে তেমন কোন উপায় ছিল না। যদি তিনি কর না বাড়াতেন তাহলে আক্রমণকারী ঠেকাতে এত বড় একটা সেনাবাহিনী কীভাবে তৈরি করতেন রাজকোষ অক্ষত রেখে? এই অ্যামবুশ বা চোরা আক্রমণ হবার আগপর্যন্ত এই অভিযানের সফলতা নিশ্চিত ছিল। প্রায় প্রতিবারেই তাঁর সেনাবাহিনী শত্রু যোদ্ধাদের সাথে লড়াই করেছে, শত্রুরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই মাত্র যতটা ক্ষতি হয়ে গেল, এমনটা আর কখনো হয়নি আগে।