আরো একবার ধোঁয়া এসে বাধা দেয়ার পর তাকাতেই নিকোলাস অনুমান করতে পারল এর কারণ। সৈন্যসারির পাশাপাশি হাওদাসহ দুটি বিশাল হাতি চলতে শুরু করেছে, চারপাশে ব্যানার বাহকদের। নিজের সৈন্যদেরকে দৃঢ় হতে উৎসাহ দিচ্ছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। রাজা রাম সিং রাঠোর নির্ঘাৎ বিজয়ীর খেতাব নিতে চাইছে নিজের মাথায়, যেন রাজপুত সৈন্যদের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে সবাই। আবার বিদ্রোহী দুই ভাইকে হত্যা অথবা বন্দি করার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়া হবে ধর্মতের যুদ্ধে চাচাত ভাই যশয়ন্ত সিংয়ের পরাজয়ের। কিন্তু পরিষ্কারভাবে দেখা গেল এই বেপরোয়া মনোভাবের কারণে মূল্য দিতে হচ্ছে তার সৈন্যদের, শত্রু সারির মাঝখান থেকে গর্জে ওঠা কামান বা বন্দুকের গুলিতে পড়ে যেতে লাগল একের পর এক সৈন্য।
শ্বেত-শুভ্র তেজী ঘোড়র উপর থাকা রাজা রাম সিং রাঠোর আর তার দুই পাশের ব্যানার বাহকেরা অলৌকিকভাবে রয়ে গেল একেবারে অক্ষত আর তাই সবার আগে পৌঁছে গেল বিদ্রোহী দুই ভাইয়ের চারপাশ ঘিরে থাকা সৈন্যদের মাঝে, ঠিক পেছনেই আছে প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসা রাজপুত বাহিনী।
এতদূর থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে সবকিছু দেখা বেশ কষ্টকর হলেও নিকোলাসের চোখে পড়ল, একজন রাজপুত সৈন্য গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা হাতির উপর। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত আর রণসাজে সজ্জিত আরো কয়েকটি অশ্বের মত এ ঘোড়ার মুখে মুখোশ লাগান, হাতির মাহুতের উপর আঘাত করল রাজপুত সৈন্য। কিন্তু হাওদার একজন দেহরক্ষী উঠে দাঁড়িয়ে দুবার চালাল তার হাতের বর্শা। চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল ঘোড়া আর তার রাজপুত আরোহী।
রাজা রাম সিং রাঠোরের একজন ব্যানার বাহক পড়ে গেল। কিন্তু অন্যান্যরা রয়ে গেল নেতার কাছাকাছি। অন্য আরেক রাজকীয় হাতির দিকে ছুটে গেল রাজা। প্রতিপক্ষ হয় তার কাছ থেকে সরে গেল নয়ত কেঁপে উঠল আঘাতের চোটে। হঠাৎ করেই বাকি ব্যানার বাহক সামনের দিকে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে আর মাটির উপর নিজের কমলা রঙা ব্যানার নিয়েই জড়িয়ে গেল। এরপর গর্জে উঠল রাজার নিজের সাদা ঘোড়া। সেও কি হাতির মাহুতকে আঘাত করার কথা ভাবছিল? কিন্তু পেছন দিকে সরে এলো ঘোড়া, আর যেই মুহূর্তে পেছনে হেলে গেল জটা, সাথে সাথে নেমে উদ্যত তলোয়ার বাগিয়ে ধরে আর নিচু হয়ে হাতির দিকে ছুটে গেল রাজা। লেবুরঙা পাগড়ি আর কমলা সাদা জোব্বা পরিহিত রাজাকে চিনতে একটুও কষ্ট হল না। সাহসের সাথে চেষ্টা করল হাতির পেটের নিচে ঢুকে যেতে; সম্ভবত হাওদার জায়গায় পেটের নাড়ী কেটে দেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন সফল হতে পারল না রাজা; পড়ে গিয়ে আহত হল আর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই চ্যাপ্টা হয়ে গেল হাতির পায়ের নিচে পড়ে।
রাজার অকুতোভয় সৈন্যরা তারপরেও যুদ্ধ করতে লাগল। দ্রুত বাড়তে থাকা ধোয়ার মাঝে দিয়েও নিকোলাসের চোখে পড়ল রাজপুতদের সাথে আরো যোগ দিতে শুরু করেছে দারার মধ্যভাগের অশ্বারোহী সৈন্যরা–অযোধ্যা, কাশ্মির আর অন্যান্য জায়গা থেকে আগত বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ যোদ্ধারা। আওরঙ্গজেব আর মুরাদের হাতিদ্বয় ইতিমধ্যে ঘুরে গিয়ে অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনী সহ নিজেদের সৈন্যগণের মাঝে ঢুকে গেল নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে। তলোয়ার দিয়ে কচুকাটা করতে করতে তাদের পিছু নিল দারার অশ্বারোহী বাহিনী। দারার বাহিনী অল্প একটু এগিয়ে গেলেও যুদ্ধ যে কঠিন আর সমানে সমান হচ্ছে তা পরিষ্কারভাবেই বোঝা গেল। দারার সুউচ্চ হাওদা ধীরে ধীরে একেবারে যুদ্ধের মাঝখানে এগিয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল নিকোলাস। এমনকি দারা মাত্র আধা ঘণ্টারও কম সময় আগে নিজের সত্যিকারের যাত্রা শুরু করলেও নিকোলাসের কাছে মনে হল যুদ্ধের গতি বড় বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বুঝতে পারল এখনই নিজের সৈন্যদের নিয়ে তারও উচিত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, কিন্তু কোথায়? আবারো ময়দানের প্রতিটি অংশ ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখল নিকোলাস, খেয়াল করল বাম পাশে খলিল উল্লাহ খান আর তার সৈন্যরা যেন পিছিয়ে পড়ছে। ফলে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে পড়েছে।
নিকোলাস বুঝতে পারল না এর কারণ। উত্তরের যুদ্ধে কখনো পিছু হটতে দেখেনি খলিল উল্লাহ খানকে। আবারো তাকিয়ে শূন্যস্থানটাকে ক্রমশ বেড়ে যেতে দেখল নিকোলাস। আতঙ্কিত হয়ে দেখতে পেল যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে, দারার পক্ষ ত্যাগ করে চলে আসছে খলিল উল্লাহ খান আর তার উজবেক সৈন্যরা। এটা নিশ্চয়ই পূর্ব-পরিকল্পিত। সমরকন্দের বিরুদ্ধে অভিযানে আওরঙ্গজেবের বেশ কাছাকাছি ছিল খলিল উল্লাহ খান। আর দারার বাহিনীতে তাকে দেখতে পেয়ে একটু বিস্মিতই হয়েছিল নিকোলাস। কিন্তু কথা বলার সময় সহজ সুরে সংক্ষিপ্তভাবে খলিল উল্লাহ খান শুধু এটুকুই জানিয়েছিল যে একমাত্র মুকুটধারী সম্রাটের প্রতিই বিশ্বস্ত সে, অতীতে আওরঙ্গজেবের দক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধা যাই থাকুক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। এখন বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে ভণিতা করেছে খলিল উল্লাহ খান; অপেক্ষা করেছে কখন মোক্ষম আঘাত হানতে পারবে।
যেন নিকোলাসের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করতেই দারার সামনে সৃষ্টি হওয়া শূন্যস্থানের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো একদল বিদ্রোহী বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্য। খলিল উল্লাহ খানের প্রস্থানগামী সৈন্যদের পাশ দিয়ে এগিয়ে এলো, যেন নিশ্চিতভাবেই জানে যে কোন ধরণের সাবধানতার প্রয়োজন নেই। খলিল উল্লাহ খানের কীর্তি দারাও দেখতে পেয়েছে নির্ঘাৎ, কেননা ঘুরে গিয়ে তার হাতিও হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসতে চাইল, পেছনে দেহরক্ষীর দল। ইশারা করে নিজের সৈন্যদের ঘোড়ায় উঠে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিল নিকোলাস। জানে এখন তাদের দায়িত্ব কী–দারার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফাটলটাকে মেরামত করতে সাহায্য করা।