এটা বেশ সাহসী পদক্ষেপ, মাননীয় শাহজাদা; কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? জানতে চাইল রাজা জয় সিং, একটা আক্রমণে সমস্ত বাহিনীকে ব্যবহার করা? অনিশ্চিত ভবিষ্যত বা কোন প্রতিরোধের জন্য কয়েক রেজিমেন্ট সৈন্যকে রিজার্ভ রাখা উচিত নয় কি?
সৈন্যদেরকে ধরে রাখলেই বরঞ্চ প্রতিরোধ বেশি আসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার সুনিপুণভাবে আঘাত করে আজকের মাঝেই শেষ করতে হবে এ যুদ্ধ। আমাদের সৈন্যদের প্রস্তুত হতে কত সময় লাগবে?
এক ঘণ্টা, সম্ভবত, শাহজাদা। উত্তরে জানোলো রাজা। আর এবার, আমি পরামর্শ দেব আক্রমণের সফলতার জন্য শত্রুর সারিতে কামানের গোলা ছুঁড়ে সৈন্যদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া সহ তাদের বাকি কামানগুলোকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য।
প্রয়োজনীয় আদেশ দিয়ে দিন।
ভুলে যাবেন না, মাননীয় শাহজাদা, যখন আমরা নিজেদের প্রস্তুতি নিতে থাকবো, পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শত্রু সৈন্যরা জড়ো হয়ে আমাদের উপর চড়াও হবার কোন পাঁয়তারা করছে কিনা।
আরেকটা বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য, ভেবে দেখল নিকোলাস। যুদ্ধের ক্ষেত্রে, ঠিক যেমন প্রতিযোগিতায় হয়, শুধুমাত্র নিজের পরিকল্পনা নিখুঁত করাটাই যথেষ্ট নয়, শত্রুর দিকেও তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে আর উত্তর দেবার ব্যাপারেও সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা আরো বেশ কিছু গুপ্তচর পাঠিয়ে দেব, যেন শত্রুপক্ষের যে কোন তৎপরতা তৎক্ষণাৎ জানা যায়। যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে সংখ্যায় কম হবার কারণে আমার ভাইয়েরা আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। আমি নই। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিন, জয় সিং। আমার বিশ্বস্ত আর বিজ্ঞ উপদেষ্টামণ্ডলী, আমি আপনাদের সবার কাছে ঋণী। আর আমার পিতা, আমাদের সত্যিকার সম্রাটও একই কথাই বলবেন। সবাইকে সৌভাগ্যের শুভেচ্ছা আর আল্লাহ বিজয় দিয়ে আমাদেরকে আশীর্বাদ করুন। সভা শেষ করা হল।
আবারো বিস্মিত হয়ে নিকোলাস ভাবতে লাগল, শেষ মন্তব্যের মাধ্যমে দারার আন্তরিক বদান্যতা ভাব ফুটে উঠলেও কর্মকর্তারদের সাথে আরেকটু সময় না কাটানোর সিদ্ধান্তটা হয়ত ভালো হয়নি। কেননা, সেনাপতিদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, তার সহজ রণকৌশল সম্পর্কে আরো পরামর্শ নেয়া, নিদেনপক্ষে সকলকে উৎসাহী করে তোলার জন্য বিশেষভাবে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন ছিল যে এই বিজয় কেন সাম্রাজ্যের আর তাদের জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে দারাকে চেনার সুবাদে পরিবার, ব্যক্তিগত জীবন আর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সাথে দারার উষ্ণ আর মনোমুগ্ধকর আচরণ সম্পর্কে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল নিকোলাস। এখন মনে হল সমর্থকদের সাথে এহেন আলোচনার ক্ষেত্রেও আরেকটু খোলামেলা, সহজ হতে পারত দারা। এখন পর্যন্ত দারার হাতে সৈন্যের যে সর্বাধিক সংখ্যা আছে, তাতে তার রণকৌশল সফল হওয়া উচিত আর আল্লাহ চাইলে, সন্ধ্যার মাঝে সে আর তার সৈন্যরা বিজয়ীর বেশে ঘোড়া ছুটাতে পারবে আগ্রার দিকে।
দেড় ঘণ্টা পরে, নিজের বাদামি ঘোড়ায় চড়ে দারার তাঁবুর পেছনে আবারো ছোট্ট পাহাড়টার মাথায় উঠে গেল নিকোলাস। পুরোদস্তুর রণ সাজে সজ্জিত হয়ে এবার ঘামতে লাগল বুক আর পিঠের বর্মের নিচে, ডান পাশে লম্বা তলোয়ার আর নীল কোমরবন্ধনীর সাথে আটকে আছে কাকৃতি-হাতলঅলা দুইটা পিস্তুল। ঢাকের বাজনা বেজে উঠতেই তাকিয়ে দেখতে পেল সামনের সারিতে প্রায় দেড় মাইল লম্বা লাইন ধরে একত্রে এগোতে শুরু করেছে দারার সৈন্যরা। ডান পাশে রাজা রাম সিং রাঠোরের রাজপুত সৈন্যরা আর বাম পাশে খলিল উল্লাহ খানের উজবেক সৈন্যগণ। একটু আগে দুই সেনাবাহিনীর মাঝে কামানের গোলা বিনিময়ের ফলে সৃষ্ঠ সাদা ধোয়ার মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করল দলটা। একটু আগেই আশি মিনিট ধরে উভয় পক্ষ যথেষ্ট গোলাবারুদ খরচ করে ফেললেও কোন পক্ষই মনে হল না তেমন ক্ষত্রিস্থ হয়েছে। শুধুমাত্র স্পষ্ঠভাবে চোখে পড়ল একে অন্যের কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে বিশাল ধূসর পাথরখণ্ডের মত পড়ে আছে দারা আর মুরাদের তিনটা হাতি। কামানগুলোকে আরো একটু এগিয়ে আনতে গিয়ে কুপোকাত হয়ে গেছে বিশাল জন্তু তিনটা।
একে একে আরো সৈন্য এসে এগোতে শুরু করল দারার বাহিনী থেকে। একটু পরে দারার নিজের বিশাল হাতিও এগোতে শুরু করতেই রত্নখচিত সুউচ্চ হাওদা থেকে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল শাহজাদা। তার হাতির আকার আর হাউদার নির্মাণগুণে সকল সৈন্যরা শাহজাদাকে দেখছে আর সে নিজেও অন্যদেরকে দেখতে পাচ্ছে যা ভিন্ন কোন উপায়ে সম্ভব হত না।
নিজ সৈন্যদেরকে নিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই থাকার জন্য শাহজাদার আদেশ পালন করতে গিয়ে ছোট্ট পাহাড়টার উপরে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সেনাবাহিনীর এগিয়ে যাওয়া সহ যুদ্ধের গতি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস। মাঝে মাঝে কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া এসে দৃষ্টিপথে বাধা দিচ্ছে, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে কতটা এগোল যুদ্ধ।
ডান দিকে রাজা রাম সিং রাঠোরের কমলা আর কেশর রঙা পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী সৈন্যরা বাকিদেরকে ছেড়ে এগিয়ে গেল দ্রুত শত্রুপক্ষের একেবারে মাঝখানে গিয়ে আঘাত হানল।