যাই হোক, এর এক কি দুই মিনিট পর আবার শত্রু কামানের পাশে যুদ্ধরত সৈন্যদের দিকে তাকাতেই দেখা গেল, আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সেনাবাহিনীর বাম পাশ থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদের বিশাল একটি অংশ টগবগিয়ে এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল দারার বাহিনীর উপর। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথর খণ্ডের উপর, এমনভাবে কামানের কাছে-দূরে চলতে লাগল যুদ্ধ। ধীরে ধীরে ফলাফল চলে গেল শত্রুবাহিনীর অনুকূলে আরো বেশি সংখ্যক সৈন্য এসে যোগ দিতে লাগল তাদের সাথে।
প্রায় বিশ মিনিট পরে দেখা গেল ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে দারার ব্যানার। আর কোন সন্দেহই রইল না। দারার অশ্বারোহীরা, সংখ্যায় একেবারে কমে গিয়ে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে আসতে চাইছে নিজেদের সারির দিকে। মুরাদ আর আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া না করলেও পড়ে যেতে লাগল আরোহী, বন্দুকের গুলি এসে ধাক্কা দিচ্ছে সবাইকে। কমলা পোশাকের এক রাজপুত সৈন্য পড়ে গিয়েও পা আটকে ফেলল পা-দানির সাথে। ঘোড়াটা তাকে বহুদূর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ভেঙে গেল চামড়ার পা-দানি। নিথর হয়ে পড়ে যাবার আগে আরো বার কয়েক পাড়িয়ে গেল দেহটা। অন্যদিকে আবার আরেক জন সাহসী অশ্বারোহী শত্রুর গুলির মুখে আঁকাবাঁকা হয়ে নিজের ধূসর রঙের ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে ছো করে তুলে নিয়ে এলো নিজের আহত সহযোদ্ধাকে। অন্যান্য ঘোড়াবিহীন সৈন্যরাও দৌড়ে, মাটি ঘষটে ঘষটে যেভাবে পারছে ফিরে আসতে চাইছে নিজেদের সারির দিকে, দেহবর্ম আর শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে দিয়েছে অনেকে, যেন চলতে গিয়ে ভারের কারণে গতি না থেমে যায়।
একটা আরোহীবিহীন আতঙ্কিত ঘোড়া–অনেকগুলোই আছে এমন মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল এক সৈন্যকে, বেচারা পাশ দিয়ে যাবার সময় চেষ্টা করেছিল ঘোড়ার লাগাম ধরতে। বহুকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে ডান পা টেনে টেনে ফিরে আসতে লাগল সৈন্যটা। শীঘ্রি বাকিরা যারা ঘোড়ার পিঠে ছিল, এসে পড়ল নিজেদের সঙ্গীদের ভেতরে, নিরাপত্তার মাঝে। একেবারে শেষে যারা এসেছে, তাদের মাঝে আছে একজন ব্যানার বাহক সৈন্য, তার আহত ঘোড়াটা প্রায় শখানেক গজ দৌড়ে এসে এখন ঢলে পড়ল আস্তে করে। স্থূলকায় পাঞ্জাবী সৈন্যটা ভারী ব্যানার হাতে নিয়েই দৌড়ে পার হয়ে এল বাকি পথটুকু। অন্য দিকে সহিসেরা দৌড়ে এসে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল আহত সৈন্যদেরকে, মারাত্মকভাবে আহতদেরকে হাতে বানানো খাঁটিয়াতে যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল হাকিমদের তাঁবুর দিকে।
এর আগে একদিন হাকিমদের একটা তাঁবুতে উঁকি মেরেছিল নিকোলাস, দেখতে পেয়েছিল লাল-অ্যাপ্রন পরিহিত চিকিৎসকেরা শান্ত মুখে সাজিয়ে রেখেছে নিজেদের ছুরি, কাঁচি আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি, অন্যদিকে সাহায্যকারীরা আগুন জ্বেলে প্রস্তুত করে রেখেছে লোহার পাত। তাড়াতাড়ি অন্যপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল নিকোলাস, আহত হলে কী করা হবে তাকে নিয়ে সেটা আর ভাবতে চায়নি মন। এর পরিবর্তে গভীরভাবে ভেবে দেখতে চাইল, অশ্বারোহীদের উপর নিজেদের বিজয়ের সুযোগ নিয়ে কেন পিছু ধাওয়া করে এলো না আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। এমন সময় এক কর্চি এসে জানালো নিজের তাঁবুতে যুদ্ধসভা ডেকেছে দারা।
কাছাকাছি থাকায় প্রথমেই পৌঁছে গেল নিকোলাস। শামিয়ানার নিচে ঢুকতেই দেখতে পেল স্বর্ণের দেহবর্ম পরে ভাইদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দারা, সেখানে শ্রমিকেরা অসহ্য গরম উপেক্ষা করেও যুদ্ধ করছে প্রথম আক্রমণে ধরাশায়ী হয়ে যাওয়া কামানগুলোকে ঠিকঠাক করতে। অন্যরা ষাড় দিয়ে টেনে আনা গাড়ি থেকে কামানের গোলা আর বারুদ নামিয়ে সাজিয়ে রাখছে গোলন্দাজদের কাছে। আরো একদল সৈন্যের হোট একটা দল ছুটে বেড়াচ্ছে আহত আর নিহত সৈন্যদের মাঝে। কয়েকজনকে বয়ে নিয়ে যেতে দেখতে পেল নিকোলাস, নিঃসন্দেহে নিজেদের সৈন্য। অন্য আরেকটা দল আহত ঘোড়াগুলোর গায়ে বিঁধিয়ে দিচ্ছে বর্শা। মনে হল জম্ভগুলোকে দুদর্শা থেকে মুক্তি দেবার শুরুভার কাঁধ থেকে নামিয়ে ছুটে গেল অন্য দেহগুলোর দিকে। ঝুঁকে পড়ে খুঁজে দেখল মূল্যবান কিছু পাওয়া যায় কিনা; এরপর বুকের মাঝে ঢুকিয়ে দিল বর্শার ফলা। একজন আহত সৈন্য কী ঘটছে দেখতে পেয়ে হঠাৎ করেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দৌড়ে আসতে চাইল দারার সারির দিকে টলোমলো পায়ে। কিন্তু দেখতে পেল একজন হত্যাকারী। এক লাফে আহত সৈন্যের কাছে এসে সহজেই ধরে ফেলল, মাটিতে ফেলে আগ্রহের সাথে গেঁথে ফেলল নিজের বর্শা দিয়ে।
দারা, পরিষ্কারভাবে সেও দেখতে পেয়েছে পুরো ঘটনাটা। চিৎকার করে উঠল, কেমন করে তারা এত নিষ্ঠুর হচ্ছে?
মাননীয় শাহজাদা! এটা যুদ্ধ আর যুদ্ধ নির্মম হয়, বিশেষ করে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু এর চেয়েও খারাপভাবে শক্তহস্তে সৈন্যদেরকে মারা যেতে দেখেছি আমি উত্তরে অভিযানে। উত্তর দিল নিকোলাস।
যুদ্ধের ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি। সত্যি কথা বলতে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে অল্প আর আমি অল্পই চাই। যত শীঘ্নি এই যুদ্ধ শেষ হয় ততই মঙ্গল।
এই ফাঁকে দারার বাকি সেনাপতিরা এসে জড়ো হল তার চারপাশে আর তাদেরকে স্বাভাবিক পদ্ধতি বা দরবারের ব্যঞ্জনাপূর্ণ স্বাগত না জানিয়েই শাহজাদা বলে উঠল, আমি দেখেছি কীভাবে আমাদের সাহসী লোকগুলোকে হত্যা করছে শত্রুরা, যারা অশ্বারোহীরা পিছু হটাতে আহত হয়ে পড়ে আছে সেখানে। আমি তাদেরকে আবারো এ সুযোগ দিতে চাই না। আমরা আর কখনো পিছু হটে আসবো না। আমাদের পরবর্তী আক্রমণ হবে হাতে থাকা সমস্ত সৈন্য নিয়ে একযোগে।