নিকোলাস আর তার ভাড়াটে সৈন্যের ক্ষেত্রে দারার আদেশ হল তার যুদ্ধ পরিচালনার তাঁবুর ঠিক পেছনেই সংরক্ষিত সৈন্য হিসেবে প্রস্তুত থাকা। যে কোন দুর্বল জায়গায় আঘাত হানার জন্য সদা তৎপর থাকা। এই কাজে নিজেদের সামরিক অভিজ্ঞতা আর তুমুল যুদ্ধের মাঝেও স্নায়ুর দৃঢ়তা বজায় রাখার ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে।
নিজের লোকদের মাঝে দ্রুত ঘুরে বেড়াতে লাগল নিকোলাস। এখনো ঘুমিয়ে আছে বা স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে এরকম সৈন্যদেরকে ঝাকুনী দিয়ে জাগিয়ে দিল, উৎসাহের বাণী শোনালো প্রত্যেককে, তলোয়ারগুলোর ধার পরীক্ষা করে দেখল; কিন্তু সবাইকে বারবার সেটা স্মরণ করিয়ে দিল তা হচ্ছে নিজেদের সাথে যত বেশি সম্ভব পানি নিয়ে যাওয়া। এরপর সকালের নাস্তা নিয়ে উঠে গেল ছোট পাহাড়টার চূড়ায়, যেখানে তাঁবু গেড়েছে তার দল। জরিপ করে দেখতে লাগল বিপরীত পাশের শত্রুদের অবস্থা। শুকনো সমভূমির দুই পাশে একে অপরের দিকে মুখ করে খাটানোনা তাঁবুগুলোর মাঝে দূরত্ব দেড় মাইল। মাটির ভাঁড় থেকে লাচ্ছিতে চুমুক দিতে দিতে পানি আর দইয়ের মিশ্রণ। খেয়ে ফেলল বেশ কয়েকটা গোল পরোটা। তাওয়া থেকে গরম গরম নামানোর পর খেতে বেশ সুস্বাদু লাগে, ঠিক এখন যেমন লাগছে, সাথে মুরগির রানের হাড়;
দারার উজ্জ্বল লাল বর্ণের তাবু আর তার সেনাবাহিনীর সামনের সারি থেকে চোখ ঘুরে গেল শত্রুর তাঁবুর দিকে। দেখতে পেল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সৈন্যরাও ঘুম থেকে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি এতদূর থেকেও উৎসাহী দৃষ্টি মেলে দেখতে পেল, হাতির পিঠে হাওদা পেতে দেয়া হচ্ছে আর তাঁবুগুলোর সামনে অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ করেই–ভোর হয়েছে এখনো হয়ত এক ঘন্টাও হয়নি–শুনতে পেল সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে গর্জন করে উঠল বিপরীত পাশের ভারী তামার কামান, শত্রুর অবস্থানের মাঝামাঝি বড়সড় একটা তাঁবুর কাছ থেকে, যেটা নিকোলাস ধারণা করল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের প্রধান সামরিক দপ্তর। তার মানে দারার মত তার ভ্রাতৃদ্বয়ও আর অপেক্ষা সহ্য করতে পারছে না।
সাথে সাথে উত্তর দিয়ে গর্জে উঠল দারার কামানগুলো। অনেকগুলো গোলাই কাছাকাছি পড়ল যেমন শত্রুরগুলো, শুকনো ভূমিতে পড়ে কোন ক্ষয়-ক্ষতি ঘটালো না কেবল কাঁকড় আর ধুলার বর্ষণ ছাড়া। যাই হোক, ক্রমশ বেড়ে যাওয়া ধুলার মাঝে দিয়ে নিকোলাস দেখতে পেল গর্জে উঠল আরেকটা শক্ত কামান, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তখানেকের জন্য শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেল যেন। শব্দটা এসেছে তার পেছন দিক থেকে, বাম পাশে মনে পড়ে গেল সেখানে ছিল দারার বারুদ রসদবাহী গাড়িতে বহর, যুদ্ধ সভার উপদেষ্টারা ভেবেছিল শত্রুর কামানের গোলা ততদূর যাবে না। হয় আওরঙ্গজেবের কোন এক ভাগ্যবান কামান রেকর্ড ভঙ্গ করে গোলা ছুঁড়েছে, নয়ত দারার নিজের কোন এক বেখেয়াল গোলন্দাজ অস্ত্রের গাড়িতে গোলা ছুঁড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা এই যে, ক্ষয়ক্ষতি যেন বেশি না হয়।
এই বিপর্যয়ের উত্তরেই যেন নিকোলাস দেখতে পেল দারার অশ্বারোহী বাহিনীর একদল সৈন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। বন্দুকধারী আর পদাতিক সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে অতঃপর এগিয়ে যেতে লাগল দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানের খোলা ময়দানে। সেই একই রাজপুত আর পাঞ্জাবী সৈন্যরা যারা আগ্রা ত্যাগ করার দিনে পশ্চাদভাগের বাহিনী গড়ে তুলেছে একত্রে। যুদ্ধে এসে এখন তারা প্রথম হবে। একটু পরেই টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামানের দিকে ছুটে গেল দলটা। বাতাসে তাদের সবুজ ব্যানার উড়ছে পতপত করে, হাতে উদ্যত বর্শা আর কোনমতে নিজেদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে একজোট হয়ে দৌড়ানোর জন্য, নতুবা শত্রুর গুলির মধ্যে পরিণত হবে সহজ নিশানায়।
এমনকি এতদূর থেকেও রাজপুতদের রণহুঙ্কার শুনতে পেল নিকোলাস রাম! রাম! রাম! ছুটছে সকলে। শত্রুপক্ষ থেকে আধা মাইল দূরত্বে থাকতেই আবারো তাদের উপর গর্জে উঠল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামান। সাথে সাথে পড়ে গেল একেবারে প্রথম ব্যানার বহনকারীর তামাটে ঘোড়াটা। মাথার উপর বনবন করে করে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে আছড়ে পড়ল আরোহীর প্রাণহীন নিথর দেহ। কিন্তু দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দেহটার সাথে জড়িয়ে বাতাসে উড়তে লাগল ব্যানার। পড়ে গেল আরো ঘোড়া আর তাদের আরোহীরা। একই সাথে অন্যরা আবার পথ করে নিয়ে ছুটে চলল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। হয় আহত হল নতুবা আরোহীরা জখম হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। তারপরেও বাকি অশ্বারোহীরা একটুও না থেমে, শিরস্ত্রাণ পরা মাথা ঘোড়ার গলার সাথে লেপ্টে রেখে ছুটে চলল শত্রুর দিকে।
বন্দুকধারী সৈন্যরা আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কামানের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের তেপায়াটুল আর লম্বা নলওয়ালা বন্দুক নিয়ে নিশানা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কামানের গোলার সাথে যুক্ত হল বন্দুকের গুলি। তাদের প্রথম যৌথ আক্রমণেই খালি হয়ে গেল আরো কিছু ঘোড়র পিঠ, আরো অসংখ্য ঘোড়া হোঁচট খেয়ে পড়ল ধুলার মাঝে, গড়াতে গড়াতে ভেঙে গেল পা আর খুর। কিন্তু ততক্ষণে কামানের কাছে পৌঁছে গেল দারার অশ্বারোহী সৈন্যরা। বর্শা দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে কচুকাটা করতে লাগল গোলন্দাজ আর বন্দুকধারীদের। একটু পরেই অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেল বেশির ভাগ শত্রু বন্দুকধারীরা। আনন্দিত হয়ে উঠে নিকোলাস দেখতে পেল জিতে যাচ্ছে সম্রাটের সৈন্যরা। দারাও নিশ্চয় একই কথা ভাবছে। নিজের রক্তলাল তাবুর পাশে বিশাল যুদ্ধহাতির পিঠে হাওদার মাঝে দাঁড়িয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে শাহজাদাকে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলতে দেখল নিকোলাস।