ফরাসী সৈন্যটার হাত দুটো কাঁপছে। চেহারা হয়ে গেছে লালচে বেগুনি আর ধূসর চোখ জোড়া মাথার মত ঘুরছে। নিকোলাস কোমরবন্ধনীর কাছ থেকে নিজের পানির বোতল নিয়ে চেষ্টা করল মানুষটার মুখে কয়েক ফোঁটা ঢালতে। অল্প একটুই কেবল গড়িয়ে পড়ল সৈন্যটার ফাটা ঠোঁট আর দাঁতের সারির ফাঁক গলে। বেশিরভাগটাই গড়িয়ে পড়ল চিবুক আর গলা বেয়ে।
কাশতে শুরু করতেই আরো একটু পানি ঢেলে দিল নিকোলাস। ঢুলি নিয়ে আসোপালকি–তাঁবুতে ফিরিয়ে নিতে হবে, কিন্তু তার আগে কপালে ভেজা কাপড় জড়িয়ে দাও। আদেশ দিল নিকোলাস। হয়ত বেঁচে যাবে লোকটা, তাই আশা করছে সে। শক্ত-সমর্থ যোদ্ধা এই ফরাসী লোকটা হিন্দুস্তানে এসেছে বোর্দুয়া থেকে ফরাসী এক বণিক দলের সাথে। এরপর দলটাকে ছেড়ে চলেও আসে, কারণটা পরিষ্কার করে না বললেও অন্যদের ধারণা হাঁসের ডিমের মত বড়সড় একটা হারানো রুবির হাত রয়েছে এতে। যদি বেঁচে যায় তাহলে অন্য অনেকের চেয়ে ভাগ্যবানই বলতে হবে তাকে।
পানির বোতল থেকে নিজেও খানিকটা চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগল নিকোলাস। নিজের আরো তিনজন সৈন্য হারিয়েছে সে–দুজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে প্রতিবেশী পদাতিক সেনাদল থেকেও অসংখ্য প্রাণহীন দেহ সরিয়ে নিতে দেখেছে, তালপাতা আর মরা ডাল দিয়ে বানানো সাধারণ স্ট্রেচারের পাশ দিয়ে ঝুলছিল হাতগুলো।
ঠিক যেমনটা পরিকল্পনা করেছিল, তিনদিন ব্যাপী অত্যন্ত অবসাদময় যাত্রা শেষে দারার সেনাবাহিনী অবশেষে সফল হয়েছে আগ্রা মুখে আওরাঙ্গজেব আর মুরাদের বাহিনীর পথ রোধ করতে। নিচু পাহাড়ের উপর তাঁবু খাটানো হয়েছে–বলতে হয় ছোট্ট পাহাড়–এটি গ্রেট ট্রাঙ্ক রোডকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে আগ্রা যাবার পথে শহর থেকে দশ মাইল দূরে জায়গাটা, যেটির নাম নিকোলাস শুনেছে সামুগড়।
যখন তারা উপলব্ধি করতে পারল যে উত্তর দিকে যাবার তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ ধুলার মেঘ ছড়িয়ে পশ্চিমে ঘুরে গেল দারার বিশাল সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হওয়ার জন্য। উত্তরে একটা দিকে সৈন্য নিয়ে ধাওয়া করল দারা, পিছু নিল ভাইদের ছায়ার আর মাঝে মাঝেই ঝটিকা দল পাঠিয়ে বন্দিদের ধরে নিয়ে এলো। পুরো প্রক্রিয়াতে তেমন কিছু শিখতে পারল না দারা আর তার কর্মকর্তারা। শুধু বুঝতে পারল যে শত্রুপক্ষ অনড়, ভীতও হবে না অথবা আত্মসমর্পণও করবে না।
এইভাবে সামুগড়ের সমভূমির চারপাশে আগু-পিছু করার পর ৭ জুন সকালবেলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল দুই পক্ষের সেনাবাহিনী। উঁচু জায়গায় থাকার কল্যাণে প্রাথমিকভাবে খানিকটা সুবিধা পেল দারা। বাতাসবিহীন সকালবেলা ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল সূর্যের তেজ, তিন ভাইয়ের একজনও সাহস করল না এগিয়ে এসে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়তে। এমনকি নিকোলাসও অবাক হয়ে ভাবতে লাগল আলোচনার কোন সুযোগ হবে কিনা, যদিও সেটা পুরোপুরি আকাশ-কুসুম। গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে যা ঘটে চলেছে তা হলো উভয় পক্ষের সৈন্যরাই হয় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নয়তো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে উত্তপ্ত রোদের মাঝে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে। ইতিমধ্যে মারা যাওয়া জম্ভগুলোর উপর উড়তে শুরু করে দিয়েছে শকুনের দল, চেয়ে আছে চোখ আর পেট থেকে ফুলে বেরিয়ে থাকা নীলচে অন্ত্রের দিকে, অনিচ্ছাকৃতভাবেও নিজের সম্ভাব্য গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সৈন্যদেরকে যখন যুদ্ধ আসলেই শুরু হবে।
চারপাশে তাকিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল, কোন দিকের সেনাবাহিনীর মাঝেই কোন রকম নড়াচড়া নেই। শুধু কম বয়সী পানি বাহকেরা নিজেদের থলি আর বোতল নিয়ে সৈন্যদের মাঝে ঘুরছে তৃষ্ণার্তকে দেয়ার জন্য, যদিও যথেষ্ট নয়। পানি যথেষ্ট নেই–গরমে তাই থামানো যাচ্ছে না সৈন্যদের নিস্তেজ হয়ে পড়া।
পরবর্তী দুই ঘণ্টায় নিজের আরো দুজন লোককে হারাল নিকোলাস, একজন অল্প চুলঅলা স্কটিশ, নাম অ্যালেক্স গ্রাহাম মুরাদের সাথে উত্তরে প্রথম অভিযানের সময় থেকেই আছে নিকোলাসের সাথে, অনুনয় করে গেছে, যেন কোমরের থলেতে থাকা পাঁচটা রুপার মুদ্রা স্কটিশ হাইল্যান্ডে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয় নিকোলাস। যদিও তাকে আশ্বাস দিয়েছে নিকোলাস; কিন্তু জানে যে কত অসম্ভব কাজ হবে এটা, এমনকি যদি সে বেঁচেও যায়, ব্রিটেনে তো হিন্দুস্তানের মতই গৃহযুদ্ধ চলছে।
গভীর চিন্তায় এই প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে বিপরীত দিকে সেনাবাহিনীর মাঝে চাঞ্চল্য দেখা গেল। অবশেষে আক্রমণ করতে আসছে তারা? চিৎকার করে নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত হতে জানিয়ে দিল, খুশি হল যে যাক, অপেক্ষার পালা শেষ হবে–ভয়ংকর গরমে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই বুঝতে পারল যে আজ আর কোন যুদ্ধ হবে না। নিজেদের তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে শত্রুপক্ষ, বর্তমান অবস্থান থেকে এক মাইল পেছনে শীঘি একজন কর্চির মাধ্যমে দারাও নির্দেশ পাঠালো পাহাড়ের উপর নিজেদের তাঁবুতে ফিরে যেতে। অন্তত আরো একটা দিন বেঁচে রইল তাহলে, ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে, নিজের লোকদের ইশারা করে যেতে যেতে ভাবল নিকোলাস।
.
২.৯
পরের দিন সকালবেলা ভোর হবারও আগে ঘুম থেকে জেগে উঠল নিকোলাস। সত্যি বলতে, রাতে তেমন ঘুমই হয়নি। গতকাল সন্ধ্যায় যুদ্ধ উপদেষ্টাদের সভায় সবাই একমত হয়েছে যে আরো একটা দিন প্রতিপক্ষের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। তাদের উচিত সংখ্যার দিক থেকে বেশি হবার সুযোগ নেয়া প্রতিপক্ষের পঞ্চাশ হাজারের তুলনায় দারার সৈন্য সংখ্যা আশি হাজার। সকাল হবার সাথে সাথেই অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করতে হবে।