গুপ্তচর রবি কুমারের প্রথম শব্দ শুনতে পেয়েই বিস্ময়ের ধ্বনি বেরিয়ে এসেছে উপস্থিত অফিসারদের মুখ থেকে। এবার কথা বলে উঠল লম্বা, সুন্দর করে ছাঁটা দাড়িঅলা একজন। গোয়ালিওরের কাছে ছোট্ট একটা অঞ্চলের শাসক রাজা রাম সিং রাঠোরকে চিনতে পারলো নিকোলাস। সাহস আর সামরিক পাণ্ডিত্য উভয় বিষয়েই সুখ্যাতি আছে রাজার। জানতে চাইলো, আমরা যতটা ভেবেছি তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে এসেছে তারা, মাননীয় শাহজাদা। সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে তাদের সঙ্গে?
রবি কুমারকে উত্তর দেবার জন্য ইশারা করল দারা।
আমি খুব বেশিক্ষণ থাকি নি বা কাছাকাছি যেতে পারি নি। কিন্তু মনে হয় প্রথম দিককার রসদবাহী মালগাড়ি আছে তাদের সাথে। সবসময় অন্য গাড়িগুলোও আসছে একটা একটা করে। আর দিগন্তে ধুলার মেঘ দেখে মনে হয়েছে আরো সৈন্য আর রসদ আসার এখনো বাকি আছে। আমার অনুমান আগামীকাল পুরো দিন লেগে যাবে নদী পার হয়ে তীরের কাছে পুনরায় একত্রিত হতে।
ধন্যবাদ, রবি কুমার। বলে উঠল দারা। ফিরে তাকাল সেনাপ্রধানদের দিকে। আমরা তাবু ভেঙে দিয়ে নদী পারাপার শেষ করার আগে তাদেরকে ধরতে পারি না?
খানিকক্ষণ বিরতির পর আবারো কথা বলে উঠল রাজা রাম সিং রাঠোর, না, মাননীয় শাহজাদা। যদি সাথে ভারী অস্ত্র আর যুদ্ধহাতি নিতে চাই, আমার মনে হয় আমরা পারব না। এখন পর্যন্ত একদিনে মাত্র আট মাইলের মত চলতে পেরেছি আমরা। প্রাণীগুলোকে সর্বোচ্চ গতি দিয়ে এগোতে চাইলেও মনে হয় না দুই দিনের কমে সেনাবাহিনী সর্বশক্তি দিয়েও নদীর কাছে পৌঁছাতে পারবে। ততক্ষণে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আগ্রার দিকে যাত্রা শুরু করে দেবে আর তাদেরকে ধরা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
আমিও এই ভয়টাই পাচ্ছি। বলে উঠল দারা। রবি আর অন্যান্য গুপ্তচরেরা ফিরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে যতটা পেরেছি মানচিত্র দেখে কথা বলেছি চম্বলের তীরের থেকে আসা নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শত্রুরা যদিও নদী পার হয়ে এসেছে, আমরা তাদের চেয়ে উত্তরে আর আগ্রার বেশি কাছাকাছি আছি। তাই তারা যতই দ্রুত এগোক না কেন আমার মনে হয় যদি ভোরের আগে তাঁবু ভেঙে দিয়ে এখন থেকে পশ্চিমে এগোতে শুরু করি, তাহলে তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য পথিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যাবো আমরা। আপনাদের কী মনে হয়?
কোন ধরনের ভূমি পার হতে হবে আমাদেরকে? জিজ্ঞেস করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ। বক্তাকে দেখতে পেল না নিকোলাস।
আমাকে বলা হয়েছে অল্প কিছু বাধা বিপত্তি ব্যতীত বেশির ভাগটাই সমভূমি। যদিও কয়েকটা জায়গায় গভীর বালি আছে, যার কারণে ভারী যন্ত্রপাতির গতি খানিকটা শ্লথ হয়ে যেতে পারে। তার পরেও আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে এগিয়ে যাবার জন্য।
আবারো কথা বলে উঠল প্রশ্নকর্তা। ধন্যবাদ, শাহজাদা। এক্ষেত্রে আর কোন সমস্যাই রইল না। সৈন্য আর জম্ভগুলো এত নিঃশোষিত হয়ে যায়নি যে সারা রাতের বিশ্রামের পরেও তরতাজা হয়ে উঠবে না। শব্দগুলো খানিকটা কুণ্ডলী পাকানো হলেও অর্থ বোঝা গেল পরিষ্কারভাবে। সমস্বরে চিৎকার করে একমত হল সকলে। পাগড়ি পরিহিত মাথা নাড়ল অন্য কর্মকর্তারা।
সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে তাহলে। বলে উঠল দারা। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের ভার আমি আপনাদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি, আমার বিশ্বস্ত সেনাপ্রধানেরা। লক্ষ্য রাখবেন সৈন্যরা যেন খানিকটা বেশি খাবার পায়। খুশি হবে সকলে। তাদেরকে জানাবেন, আপনাদের মতই তাদেরকেও পুরস্কৃত করব আমি, যখন বিজয় হবে আমাদের। এর সাথে উঠে গেল দারা। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল তাঁবুর ভেতরে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার সূর্যালোকে নিজের তাঁবুর দিকে ফিরতে গিয়ে আপন মনে নিকোলাস না ভেবে পারল না যে, সেনাবাহিনীর জন্য খাবার আর পুরস্কারের ব্যাপারে যতটা উদার দারা, নিজের কর্মকর্তাদের উপর যতটা তার আত্মবিশ্বাস, তাহলে শাহজাদা নিজে কেন আরেকটা প্রধান ভূমিকা পালন করলো না। অন্তত নিজের সেনাপ্রধানদেরকে আরো একটু ভালোভাবে জানার সুযোগ পেত দারা। বিশেষ করে যেসব প্রজা রাজ্যের শাসক, যারা সেনাবাহিনী আগ্রা ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে সম্রাটের নির্দেশে শহরে এসে পৌঁছেছে; কিন্তু শাহজাদার সাথে মিলিত হবার সুযোগ পায়নি। একজন নেতার প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ততা আদায়ের জন্য বিশেষ করে একজন সম্ভাব্য সম্রাট যে কিনা গৃহযুদ্ধ লড়ছে, অধঃস্তনের প্রয়োজন তাঁকে চেনা, জানা একই সাথে নিজের ভব্যিষত সম্পর্কেও আশাবাদী হয়ে উঠতে পারবে তাহলে নিম্নপদস্থরা। উত্তরের দুই অভিযানের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিকোলাস জানে যে আওরঙ্গজেব অথবা মুরাদ কেউই এমন সহজ আচরণ করেনি। কিন্তু দারার সহজাত চারিত্রিক মাধুর্যও তাদের ছিল না আর অভিযানগুলোও ভয়ংকর পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। ঈশ্বর চাইলে তাদেরকে আবারো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
*
আস্তে করে ঘোড়র উপর থেকে বালুময় ভূমিতে পড়ে গেল ফরাসী লোকটা। দেখামাত্র নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে লোকটার কাছে চলে এলো নিকোলাস। নিশ্চিত যে অসহ্য গরমের কবলে পড়ল আরো এক ভুক্তভোগী। দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা সৈন্যের কাছে গিয়ে চিৎকার করে তাকে শুইয়ে দিল নিকোলাস। তারপর অন্য সহকর্মীদের সহায়তায় তাড়াতাড়ি খুলে ফেলল ভারী লোহার দেহবর্ম, তুলে নিল বুকের উপর থেকে এত তেতে আছে যে মনে হল হাতে ছ্যাকা লাগবে গরমে।