তীরন্দাজরা পাশ দিয়ে চলে যেতেই গরমে আরো বেশি ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল নিকোলাস। পূর্ববর্তী অভিযানের চেয়ে সংখ্যায় কম হলেও এদের জোড়া ধনুক আর পালক লাগান তীর এখনো বন্দুকের গুলির চেয়েও দ্রুত ছুটতে পারে, যদিও ততটা ভয়ংকর নয় আচরণে।
শেষের একেবারে আগে এলো পদাতিক বাহিনী। কারো পায়েই জুতা নেই বলতে গেলে। সূর্যের প্রখর গরম থেকে রক্ষা পেতে হালকা সুতি কাপড় আর সাধারণ পাগড়ি পরে আছে বেশির ভাগ। কয়েকজনের হাতে তলোয়ার। বেশিরভাগের হাতে সাধারণ বর্শা। কিন্তু কয়েকজন বহন করছে যন্ত্রপাতির মত অস্ত্র যেমন কাস্তে আর কোদাল, যা দিয়ে শস্য খেতে কাজ করতেই অভ্যস্ত তারা। কিন্তু বেশিরভাগ অভিজ্ঞ সৈন্য সুলাইমানের সাথে শাহ সুজার পিছনে চলে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে এদেরকে শস্য খেত থেকে উঠিয়ে নিয়ে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়ে দিয়েছে জমিদারেরা।
যুদ্ধে এরকম অদক্ষ পদাতিকের কোন ভূমিকা কখনো দেখেনি নিকোলাস। হয় দ্রুত আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায় নয়ত প্রতিরোধ করতে গেলে সহজেই কচুকাটা হয় শত্রুর হাতে। সম্ভবত এদের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সংখ্যায় বেশি হয়ে সাধারণ জনগণ অথবা অনভিজ্ঞ সেনাবাহিনীকে ভয় পাইয়ে দেয়া। আরো আধ-ঘণ্টা কেটে গেল ইতিমধ্যেই বিশৃংখল হয়ে পড়া পদাতিক বাহিনীর এলোমেলো যাত্রা শেষ হতে। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অশ্বারোহী পশ্চাদভাগের সৈন্যদের এগিয়ে আসতে দেখতে পেল নিকোলাস–হালকা হলুদ অথবা কমলা রঙের আলখাল্লা পরিহিত সূঁচালো-কানের মেওয়ারী ঘোড়র উপর বসে থাকা রাজপুত সৈন্য আর বিশাল সব ঘোড়ার উপর বসে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ভারী দেহের পাঞ্জাবী সৈন্যদের মিশ্র একটি দল।
আনন্দে নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে হাত ইশারা করল নিকোলাস। জুন মাসের তপ্ত সূর্যের নিচে সকলেই ঘামছে তার মত, শিরস্ত্রাণ বেয়ে শ্বেদকণিকা নামছে মুখের উপর, এরপর মেরুদণ্ড বেয়ে মিশে যাচ্ছে পৃষ্ঠদেশের উপর থাকা বর্মের মাঝে। কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানালো নিকোলাস যে রসদ বোঝাই বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে হল না। কেননা হেলেদুলে এগোতে থাকে ভারী মালবাহী উট, খচ্চর আর হাড় জিরজিরে গাধার দল। আর এর সাথে আছে তাঁবুর পিছনে আসা বিচিত্র পেশার মানুষের মিছিল, দম বন্ধ করা ধুলার মাঝে চোখে পড়ল প্রায় আগ্রার ফটকের কাছে হুড়োহুড়ি করছে দলটা। এখনো সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা; রাধুনী, দড়িবাজ, দেহপসারিণী মেয়েরা আর সাপুড়ের দল তাঁবুর জীবনে শূন্যতা ভরিয়ে তোলার পাশাপাশি প্রশমিত করে দেয় যুদ্ধের উদ্বিগ্নতা। এই অভিযান যদি স্বল্প সময়ের জন্য হত আর দারা-ই হয়ে যেত বিজয়ী, আপন মনেই ভাবল নিকোলাস। ঘোড়র পেটে গুতো দিয়ে আগে বাড়ল সে আর তারই মত আরো একবার চলার সুযোগ পেয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল বাদামি ঘোড়া ছোট্ট পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে যোগ দিল দারার বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে।
*
চম্বল নদীর তীর থেকে আস্তে করে মাছের খোঁজে উড়াল দিল দুটা সারস বক। চম্বলের চিকচিকে পানির মাঝে ছায়া পড়েছে এগুলোর বিশাল লাল মাথা আর ধূসর-শুভ্র পালকের। একটা মরা গাছের গুঁড়ির উপর বসে কৃতজ্ঞচিত্ত নিকোলাস তাকিয়ে দেখছে, আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে দুপুরের কড়া রোদ, পানি থেকে হাঁক ছাড়ল লম্বা, কৃশকায় ঘরিয়াল। এটাও বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে।
ঘরিয়ালের মত কুমির আর কখনো দেখেনি নিকোলাস। স্থানীয় লোকেরা তাকে এই বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে এটা ক্ষতি করে না কারো, শুধু মাত্র মাছ খায়। আবার একই সাথে এ বলেও সতর্ক করে দিয়েছে যে, মাংশাসী কুমিরদেরকেও প্রায় অগভীর পানিতে দেখা যায়। তাই যত গরমই পড়ুক না কেন বা যতই ইচ্ছে করুক না কেন, নদীতে সাঁতার কাটা যাবে না।
পেছনে শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ঘুরে তাকাল নিকোলাস। না কোন কুমির নয়–মাছ খেকো অথবা অন্য কোন জাতের তার দুই কি তিনজন সঙ্গী কর্মকর্তা হেঁটে যাচ্ছে দারার তাঁবুর দিকে, যে মিটিংয়ের ডাক সেও পেয়েছে। সময়ের কথা স্মরণ করে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস, কাপড় ঝেড়ে হাঁটা ধরল তাঁবুর দিকে। যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কী কারণে হতে পারে এই সভা। পাঁচ দিন ধরে গরম আর ধুলাময় ধীর গতির যাত্রা শেষে আজ সকালে চম্বলে পৌঁছেছে সেনাবাহিনী। অনুমান করল হয়ত নদী পার হয়ে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের মুখোমুখি হবার ব্যাপারে কথা হবে সভাতে–চম্বল কি অগভীর আর আস্তে আস্তে বইছে যেন নিরাপদে পার হওয়া যায় নাকি নৌকা সেতু তৈরিতে আরো সময় লেগে যাবে।
মিটিংয়ে প্রবেশের পাঁচ মিনিট পরে শামিয়ানার নিচে নিচু ডিভানে বসে থাকা দারার চারপাশে জড়ো হওয়া ষাটজন সেনানায়কের দ্বিতীয় সারিতে দাঁড়িয়ে নিকোলাস বুঝতে পারলো সে ভুল ভেবেছে। ডিভানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রমণকারীর মত চেহারার একজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে উঠল দারা, রবি কুমার মাত্রই ফিরে এসেছে চম্বলের তীর ধরে দক্ষিণে দুই দিনের পরিদর্শন শেষে। রবি, আমার কর্মকর্তাদের সুবিধার্তে সেখানে কী দেখেছ আরেকবার খুলে বল।
মাথা নাড়ল রবি কুমার। সন্ধ্যায় আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সেনাবাহিনীকে বিশ মাইলের মত নদীর নিচের দিকে দেখেছি আমি। অগ্রবর্তী সৈন্যদের বেশির ভাগ ইতিমধ্যে পার হয়ে এসেছে; কিন্তু বাকি সৈন্যরা রান্নার জন্য আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত। দেখে মনে হয়েছে অপর পাড়েই রাত কাটাবার পরিকল্পনা আছে।