কানে তালা লেগে যাবার মত বিস্ফোরণের শব্দে কেটে গেল নিকোলাসের চিন্তার সুতো। সৈন্যদের এগিয়ে আসার শব্দ ভেসে এলো সামনের দিকে লম্বা-গলার বাদ্যের আওয়াজের মাধ্যমে।
পাশাপাশি ত্রিশ জন সৈন্য আছে একেবারে সামনের সারিতে। সকলের পরনে মোগলদের সবুজ পাগড়ি আর টিউনিক। একই রকমের দেখতে কালো ঘোড়ার উপর চড়ে বসেছে সকলে। প্রথম দিকে দুই সারিতে বাদক দলের সাথে দামামা বাজিয়েরাও আছে। নিজেদের ঘোড়ার দুই পাশে ছোট ছোট দামামাগুলোকে বেঁধে নিয়ে একই তালে বাজাচ্ছে সবাই আর জন্তুগুলোও এতটাই প্রশিক্ষিত হয়ে গেছে যে শব্দের ঝংকারেও কোন ভাবোদয় বোঝা গেল না। বাদ্য দলের পরেই আছে ঋজুদেহী অশ্বারোহীর দল। শুধুমাত্র তারা বাদে প্রতি ছয় জনে একজন, ধারণা করল নিকোলাস হাতে ধরা সবুজ ব্যানারের কাঠের দন্ড।
বাতাসে উড়ছে মোগল নিশান। প্রস্থ অপেক্ষা বেশি দৈর্ঘ্যের সবুজ পতাকার সাথে হাতে উদ্যত বর্শা। তাদের পেছনে আবারও অশ্বারোহীদের সারি। এদের হাতের বর্শার মাথায় বেঁধে রাখা সবুজ দৈর্ঘ্য বেশি পতাকাগুলো আরোহীদের দুলে ওঠার তালে তালে সৃষ্টি করে সমুদ্রের তরঙ্গ অথবা মনে হচ্ছে যেন শরতের শস্যক্ষেতের উপর বয়ে যাচ্ছে বাতাস।
কয়েক মিনিট পরে সোনালি ধুলার মাঝ দিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল যুদ্ধহাতিদের সারি। প্রতিটির উপরে বিশাল হাওদা আর লোহার পাতের দেহবর্ম। পাতগুলো এত ছোট যে হাতিগুলো স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না। নিকোলাসের মনে পড়ে গেল যে একবার শুনতে চেষ্টা করেছিল সংখ্যা, তিন হাজার পর্যন্ত গোনার পর অবশেষে ক্ষান্ত দেয়। যুদ্ধবর্মের মতই প্রতিটি হাতির শুঁড় বেঁধে রাখা হয়েছে একদিকে ধারালো বাঁকা তলোয়ার দিয়ে। শুড়গুলোকে রক্তলাল রং দিয়ে রাঙানো হয়েছে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হাওদার মাঝ থেকে উঁকি দিচ্ছে গজনাল-এর ব্যারেল। এরকম চলন্ত যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত যুতসই হোট কামান। হাতির দল একেবারে লড়াইয়ের মাঝখানে দ্রুত ঢুকে যেতে পারে এ কামানগুলো নিয়ে।
হাতিদের সারির একেবারে মাঝখানে আছে অপেক্ষাকৃত বড় জম্ভগুলো। এগুলোর শুড় লাল নয় সোনালি রঙে রাঙানো। একে অন্যের সাথে তালে তালে পা ফেলে চতুর্ভুজ আকৃতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। চারকোনার প্রতিটা কোণার হাওদা থেকে উড়ছে অশ্বারোহীদের চেয়েও বড় সবুজ ব্যানার। ছয় ফুট উঁচু আর সম্ভবত বিশ ফুট লম্বা ব্যানারগুলোতে সোনা দিয়ে অ্যামব্রয়ডারি করা হয়েছে সম্রাট আর দারা শুকোহর নাম। একেবারে মাঝখানে আছে সবচেয়ে বড় হাতি। সূর্যের আলোয় চকমক করছে সুউচ্চ হাওদার গায়ে লাগান মনি-মাণিক্য। ধীরে ধীরে হাতিটা কাছে এগিয়ে আসতেই পরিষ্কারভাবে দারার দেহাবয়ব দেখতে পেল নিকোলাস। প্রপিতামহ মহান আকবরের ন্যায় সোনার দেহবর্ম পরে বসে আছে হাওদার ঠিক মাঝখানে। পেছনে খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো দাঁড়িঅলা দুই দেহরক্ষী। পাশ দিয়ে যাবার সময় নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে একটা হাত তুলল দারা। কিন্তু নিকোলাস নিশ্চিত হতে পারল না যে তাকে কি সত্যিই চিনতে পেরেছে দারা নাকি একজন ভালো জেনারেলের মত দায়িত্ব পালন করেছে শুধু পথের পাশে থাকা সৈন্যদেরকে অভিবাদন জানানো।
আধা ঘণ্টা পরে সেনাবাহিনীর কামান চলে গেল নিকোলাসের পাশ দিয়ে। তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন নিজের সৈন্যদেরকে নিয়ে পশ্চাদ্ভাগের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়। সকালের কুয়াশা কেটে যেতেই গরম পড়তে শুরু করেছে আর নাক-মুখও ভরে যেতে লাগল ধুলায়। যাইহোক, দ্রুত নিজের চামড়ার বোতল থেকে এক চুমুক পানি মুখে দিয়ে নীল কাপড়ে আবার চেহারা ঢেকে নেবার মাঝে জমকালো গোলন্দাজ বাহিনী দেখে না চমকে পারল না। সবচেয়ে বড় কামানটি এ মুহূর্তে পার হয়ে গেল তার পাশ দিয়ে। এত বড় পিতলের ব্যারেল, রহস্যময় পাখি আর সাপের ছবি খোদাই করা প্রায় বিশ ফুটের কাছাকাছি। আট চাকার দেহটা বইতে কতটা ষাঁড় লাগছে? গুনে দেখল একটা অস্ত্র টানতে ঘেমে নেয়ে উঠছে ত্রিশটা পশু, একটা থেকে আরেকটা পশুর মাঝে দৌড়ে তাড়া দিচ্ছে সাদা-কাপড় পরা, খালি পায়ের চালক। অবাধ্য পশুর গায়ে লম্বা চাবুকের আঘাত আর দড়ি ধরে টানার ফলে এত জোরে চিৎকার করে উঠছে বঁড়গুলো যে মাঝে মাঝে পুরো সৈন্য শোভাযাত্রার শব্দ ছাপিয়েও সে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
যুদ্ধহাতির চেয়েও কামান বাবর হিন্দুস্তানে এদের আগমন ঘটিয়েছেন তাও প্রায় দেড়শ বছর হয়ে গেল–যে কোন সেনাবাহিনীর প্রাণকেন্দ্র, অশ্বারোহী বা হাতির দলের আক্রমণ ঠেকানো ছাড়াও বিস্ফোরণের মাধ্যমে দেয়াল আর ফটকদ্বার ভেঙে, খুঁড়িয়ে দিতে পারে একটা শহরের শক্তি। বারুদের প্রস্তুতকারীরা বেশিরভাগই তুর্কি ভাড়াটে সৈন্য সবসময় আরো ভালো বারুদের মিশ্রণ তৈরি করছে যেন বেড়ে যায় কামানের দূরবর্তী আঘাত ক্ষমতা আর বিশ্বাসযোগ্যতা। শুধু যদি, ভাবলো নিকোলাস, কামারশালার কারিগর এই বিশাল অস্ত্রগুলোকে আরেকটা হালকা করে তৈরি করত তবে বহনে আর গোলা ছুঁড়তে আরো সহজ হত।
কামানের পরে এলো কাঠের গরুগাড়ি, কয়েকটিতে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ঢাকনা–বারুদ বোঝাই গাড়ি–আর কয়েকটিতে ভর্তি পাথর আর লোহা পুড়ে রাখা কামানের গোলা। এদের পেছনে, বেশিরভাগই ঘোড়ার পিঠে বসে আছে আবার কেউ কেউ পায়ে হেঁটে আসছে, বন্দুকধারীর লম্বা অস্ত্র আর বারুদ ভরার শলাকা ঝুলছে তাদের ঘোড়ার গায়ে থেকে বা নিজেদের পিঠ থেকে। একই সাথে আছে বারুদের শিঙা বা চামড়ার থলেতে ভরা বন্দুকের গুলি। এদের অস্ত্রগুলো বেশিরভাগই ম্যাচলক। হিন্দুস্তানী আবহাওয়ার জন্য বেশি কার্যকর। অন্যদিকে নতুন আবিষ্কৃত হওয়া ফ্লিন্টল ধুলা অথবা সঁাতাতে আবহাওয়ায় গুলি ছুঁড়তে ব্যর্থ হয়। বন্দুকধারীদের সাথে সাথে আসছে। নতুন গুলি তৈরির জন্য রাসায়নিক বহন করে নিয়ে আসা সৈন্যরা।