সাধুবাদ জানাই যে তুমি এসেছ, কিন্তু ইতিমধ্যেই সুরাটের উপর আক্রমণের সংবাদ পেয়েছি আমি। এমনকি ঘটনা ঘটার আগেই শুনেছি যে মুরাদ আক্রমণ আর রাজকোষ লুট করার পরিকল্পনা করছে; কিন্তু আমার হাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য নেই যারা কিনা সময় মত পৌঁছতে পারবে… ।
আপনি জানেন ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি, জাহাপনা। আমার ভয় ছিল যে দেরি না হয়ে যায়।
আর তোমার কী মনে হয় আমি কি পদক্ষেপ নিয়েছি?
সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয়া যেন মুরাদ ও তার ভাই একত্রে মিলিত হতে না পারে?
ঠিক, তাই। বস্তুত, সুরাট সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন খবর পাবার আগেই আমি তা করেছি। তোমাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে, নিকোলাস। তুমি আমার বিদ্রোহী পুত্রদের দাবি বিশ্বাস করোনি যে শাসন করার পক্ষে বেশি অসুস্থ হয়ে গেছি আমি?
নিকোলাসের আহত অভিব্যক্তি দেখে গলার স্বর কোমল করলেন শাহজাহান–যাই হোক, মাতৃভূমির জন্য জাহাজ না ধরে এখানে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না ইংরেজ লোকটার।
তুমি ভাবতেও পারবে না সবকিছু কত দ্রুত ঘটে গেছে। আমার সম্রাজ্ঞী মৃত্যুবরণ করার পর থেকে এতবড় অন্ধকার মুহূর্ত আর আসেনি আর এখন আগ্রায় ফিরে এসেছ তুমি। ভেবেছিলে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিবে–এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমি তোমাকে জানাচ্ছি… মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই জানতে পেরেছি, রাজা যশয়ন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে যে শক্তিশালী বাহিনী পাঠিয়েছি তাদের সাথে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনীর দেখা হয়েছে ধর্মতে। উজ্জয়নী থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল যশয়ন্ত সিংকে–অথবা ইচ্ছেকৃতভাবে হয়ত ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে–
শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে না জেনেই সনুখ সমরের নির্দেশ দিয়ে বসে রাজা। খোলা ময়দানে তার রাজপুত অশ্বারোহীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে বিদ্রোহীদের কামান। কামানের গোলার সাথে সাথে বিদ্রোহী বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে এগোতে দেখে ভীত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে আমাদের সৈন্যরা; অনেকেই যশয়ন্ত সিং সহ পালিয়ে যায় রাজস্তানী মরুভূমিতে।
আওরঙ্গজেব আর মুরাদ এখন কোথায় আছে?
নিশ্চিতভাবে জানি না আমি। যদি তাদের জায়গায় আমি হতাম তাহলে চম্বল নদীর দিকে এগোতাম, আগ্রা আর তাদের মাঝে সবশেষ বাধা। আর তাই স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণ দিকে গোয়েন্দা পাঠিয়ে দিয়েছি যেন তারা পৌঁছানোর সাথে সাথে জানানো হয় আমাকে।
এরপর কী করবেন, জাহাপনা?
একটা মাত্র কাজই করতে পারি–বাকি সৈন্যদেরকে পাঠিয়ে তাদেরকে বাধা দেয়া। সাম্রাজ্য আর সম্মান রক্ষার্থে মাঠে নামতে হবে শাহজাদা দারাকে–আমার পিতামহের সমস্ত অর্জন হুমকির মুখে ঝুলছে এখন।
.
২.৮
আগ্রা থেকে চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সমভূমি থেকে উঠে যাওয়া ছোট্ট একটা পাহাড়ের মাথায় নিজের বাদামি ঘোড়র উপর শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে নিকোলাস। সকালের স্নিগ্ধ আলোতে দিগন্তের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল তাজমহলের পরিচিত অবয়ব। তার কাছে গম্বুজটাকে মনে হয় যেন অশ্রুবিন্দু। সম্রাটের অনুরোধে আবারো ভাড়াটে সৈন্যদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছে নিকোলাস। প্রভাতের আলো ফোঁটারও আগে নিকোলাস আর তার পাঁচশ সৈন্যকে নিয়ে বের হয়ে এসেছে দারা–রোগ, ক্ষত আর হতাশা মিলে যদিও উত্তরের অভিযানের সময়কার চেয়ে সংখ্যায় অনেক কমে গেছে তারা–চম্বল নদীর দিকে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা দেয়ার আগে সর্বশেষ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এভাবে।
হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে খাড়া পথ বেয়ে সুউচ্চ ফটকদ্বার দিয়ে নেমে এসেছে তারা। এরপর কোনরকম সামরিক বাধা ছাড়াই পার হয়ে এসেছে সমভূমি। বুক ভরে হিন্দুস্তানের অদ্বিতীয় আর অসাধারণ ঘ্রাণ টেনে নিল নিকোলাস–মাটি থেকে উঠে আসা গন্ধের সাথে মিশে গেছে রাতে ফোঁটা ফুলের গন্ধ যেমন চম্পা, মশলা আর গোবর দিয়ে আগুন জ্বালানোর গন্ধ, জেগে উঠছে সকলে, তৈরি হচ্ছে নতুন দিনের জন্য। সৈন্যদের ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে একটা ময়ূর আর নিশাচর গ্রাম্য কুকুর।
যদিও আক্ষরিক অর্থেই শান্তি ভঙ্গ হতে যাচ্ছে এখন। দারা আর সৈন্যবাহিনী এগিয়ে চলেছে ভাইদ্বয় আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সাথে সন্মুখ সমরে লড়তে। পারিবারিক বিভক্তি আর কদর্যতা নিয়ে ভেঙে পড়তে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধ। হিন্দুস্তানে আসার পর নিজের জীবনের প্রথম দিকটাতেও এসব দিন দেখেছে নিকোলাস। যখন রক্তাক্ত পরিণতি আর ধ্বংসের কথা জেনেও সিংহাসনের জন্য লড়াই করেছিল শাহজাহান। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের পশ্চিমে পারিবারিক এস্টেট থেকে পাঠানো বড় ভাইয়ের পত্রে জানতে পেরেছিল যে নিজের দেশেও শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ–রাজাকে হত্যা করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের সংসদ। আর এর গোঁড়া জননেতা অনুসরণকারীদের উপর আরোপ করেছে আওঙ্গজেব আর মোল্লাদের মত মৌলিক একটি বিশ্বাসের কঠোর আর সাদাসিধে নীতি; এমনকি থিয়েটার আর ১লা মে তারিখে পুষ্পশোভিত দণ্ডের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করার মত নির্দোষ উৎসবকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
প্রায় অবচেতনেই কোমরের কাছে রাখা দুটি পিস্তলের একটির উপর হাত রাখল নিকোলাস। ভাইয়ের শেষ চিঠির সাথে এগুলোও এসে পৌঁছেছে শক্ত করে বেঁধে রাখা একটি প্যাকেটের মাঝে। এ ধরনের অস্ত্র হিন্দুস্তানে প্রায় বিরল বলা চলে। যাই হোক, সামনের যুদ্ধে হয়ত কাজে লাগবে এ দুটো। যদিও মনে হয় না যুদ্ধের মাঝে নতুন করে গুলি ভরে নেয়ার মত যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। তাই প্রতিটি গুলি করতে হবে ভেবে-চিন্তে, জায়গা মত। যদিও অনুশীলনের সময় পনের গজের বেশি লাগাতে পারেনি সে।