সুলাইমান বাহিনীর আর কোন সংবাদ পেয়েছ তুমি?
হ্যাঁ, মাত্র গতকালই। দিলীর খানের কাছ থেকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে, একজন কসিড। সে আর সুলাইমান, বারানসী থেকে বিশ মাইল পূর্ব দিকে আছে, বাংলার জঙ্গল আর জলাভূমির মাঝে পিছু ধাওয়া করছে প্রতিপক্ষের।
হতাশ হলেন শাহজাহান। ঠিক কথাই বলেছে জয় সিং : সংবাদ মিশ্র ধাঁচের। শাহ সুজা পালিয়ে গেছে কিন্তু সুলাইমান এমনভাব করছে যেন মরণপণ যুদ্ধে নয়, শিকার করতে গেছে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে যদি যশয়ন্ত সিং আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে পরাজিত করতে পারে। কিন্তু তা না হলে সুলাইমানের সৈন্যদের প্রয়োজন পড়বে। তাই শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করার বেপরোয়া অভিযান থামাতে হবে। এই মুহূর্তেই আদেশ পাঠিয়ে শাহজাদাকে আগ্রায় ডেকে আনবেন শাহজাহান।
*
বসন্তের রৌদ্রতাপ–উষ্ণ কিন্তু তেমন কড়া নয়–আরামদায়ক লাগল চেহারার উপর এসে পড়াতে। নিজের হালকা বাদামি তেজী ঘোড়াটির উপরে আবারো উঠে আনন্দিত হয়ে উঠলেন শাহজাহান। খুব বেশি সময় লাগল না, দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠল সিকান্দ্রাতে অবস্থিত আকবরের বিশাল সমাধির লাল বেলেপাথরের তৈরি ফটকদ্বার। সম্প্রতি পাওয়া সংবাদটা আত্মস্থ করার জন্য সময় আর একাকিত্বের খোঁজে হঠাৎ করেই মন চাইল পিতামহের শেষ নিদ্রার জায়গাটিতে আসতে, যিনি তাঁকে শিখিয়েছেন একজন সম্রাটের দায়িত্ব। প্রিয় দৌহিত্রের এহেন সংকটময় মুহূর্তে আকবর বেঁচে থাকলে কী বলতেন? আকবর নিজে কখনো এমন বিপর্যয়ের মোকাবেলা করেননি। কারণ তিনি হয়ত আরো উৎকৃষ্ট শাসক ছিলেন, আরো অধ্যবসায়ী আর সাম্রাজ্যের মনোভাব বোঝার ক্ষেত্রে আরো তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী….
সবুজ পাগড়ী পরিহিত প্রহরীর দল উঠে দাঁড়াতেই ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন শাহজাহান। হয় বয়সের ভারে নতুবা অসুস্থতার কারণে অথবা হয়ত উভয়ের কারণে যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে বেশি ব্যাথা হয়ে গেছে শরীরের হাড়গোড় আর মাংসপেশী। কর্চির হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে দেহরক্ষীকে ইশারা করে আদেশ দিলেন বাইরে থাকতে। একাকী প্রবেশ করলেন ফটকদ্বার দিয়ে। বাগানে যেতেই বিস্মিত হয়ে কিচকিচ শুরু করে দিল একটা বানর, মাথা তুলে তাকিয়ে রইল গাছের নিচে চড়ে বেড়াতে থাকা তিনটি হরিণ। কিন্তু শাহজাহান সোজা তাকিয়ে রইলেন গাছের ছায়া দিয়ে ঢাকা বালি-পাথরের তৈরি পথের শেষ মাথায় পিতামহের সমাধির দিকে। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে একটু বেশিই কঠিন এই সমাধি, কিন্তু এর দৃঢ়তা ফুটিয়ে তুলেছে আকবরের চেতনাকে। শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই বড় মাপের শক্তিশালী মানুষ ছিলেন সম্রাট আকবর। সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করে গভীর আর শক্ত করেছেন এর ভিত্তিকে, ঠিক যেমন তাঁর সমাধিকে ধরে রেখেছে এর খিলানগুলো।
ধীরে ধীরে পথের শেষ মাথায় গিয়ে বসলেন সমাধির দিকে মুখ করে থাকা দুটি মার্বেল পাথরের বেঞ্চিতে। এখানে এসেছিলেন নির্জনে বসে খানিকটা ভাবতে; কিন্তু ঘোড়া ছুটিয়ে আসার পরিশ্রমে আর সারাদিনের ঘটনায় হতবিহ্বল থাকার ফলে প্রায় সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল চোখ জোড়া।
হঠাৎ করেই হতচকিত হয়ে জেগে গেলেন পাথুরে পথে পদশব্দ শুনতে পেয়ে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন দ্রুতপায়ে তার দিকে হেঁটে আসছে কেউ একজন কিন্তু গাছের ছায়া পড়ায় বোঝা যাচ্ছে না লোকটা কে। একাকী থাকতে চাওয়ার পরেও দেহরক্ষীরা কেন কাউকে ঢুকতে দিল? অবচেতনেই হাত চলে গেল কোমরবন্ধনীর সাথে ঝুলন্ত ছুরির কাছে। কে তুমি? কে তোমাকে অনুমতি দিয়েছে আমার একাকিত্বে অনুপ্রবেশ করতে? জানতে চাইলেন সম্রাট।
থেমে গেল আগন্তুক। সোনালী কেশ, দেখতে পেলেন শাহজাহান পূর্বের মত উজ্জ্বল বা ঘন নয়; কিন্তু তারপরেও ভুল হবার কোন কারণ নেই।
এগিয়ে এসো। নিকোলাস ব্যালান্টাইন কাছে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন সম্রাট।
জাহাপনা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা করুন। আপনার প্রহরীদের নেতা আমাকে চেনে। যখন আমি বলেছি যে আপনাকে দেয়ার জন্য জরুরি তথ্য নিয়ে এসেছি, আমাকে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছে।
হাত একপাশে রেখে দিলেন শাহজাহান। আরো কাছে এগিয়ে আসার পর দেখতে পেলেন ইংরেজের কৃশকায় চেহারায় চোখের নিচে গভীর কালো দাগ। আমার কন্যা তোমার কাছে চিঠি লিখত, আমি জানি, আমি … অনুতপ্ত … ভুল বোঝাবোঝির জন্য তোমাকে আগ্রা ছেড়ে যেতে হল।
জাহাপনা, এই কারণে এত কষ্ট করে ঘোড়া ছুটিয়ে আপনাকে খুঁজতে আসিনি আমি। আমি এমন কিছু বলতে চাই, যা কোনভাবেই না–অপেক্ষা করা যাবে না। গলার স্বর কেঁপে গেল নিকোলাসের।
বলো।
ইংল্যান্ড যাত্রার উদ্দেশে সুরাটে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় শহরে আক্রমণ শুরু করে আপনার পুত্র শাহজাদা মুরাদ। শহরের দেয়াল কামান দিয়ে খুঁড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজকোষ লুট করে নিয়ে গেছে…. সুরাট থেকে ফেরার সময় পথিমধ্যে কয়েকজনের কাছে শুনেছি মুরাদেরই একজন সেনাপতি নেতৃত্ব দিয়েছে এই ধ্বংসলীলায়। শাহজাদা নিজে দক্ষিণ দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে আরো বিশাল বাহিনী নিয়ে, শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সাথে মিলিত হতে… বুঝতে পেরেছি যে সাথে সাথে এ সংবাদ আপনাকে জানানো প্রয়োজন। আমি… শাহজাহানের মুখে দুঃখের বিমর্ষ হাসি ফুটে উঠতে দেখে থেমে গেল নিকোলাস।