আবারো মমতাজের শিবিকার কাছে এলেন শাহজাহান, চারপাশে বেগুনি সূর্যাস্তের আলো। প্রবেশ করলেন বোরহানপুরের প্রাচীন প্রবেশ দ্বার দিয়ে ভেতরে, দুপাশে দুটি পাথরে নির্মিত যুদ্ধহাতি যুদ্ধ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে, যদিও ধুলিঝড় আর বর্ষার বৃষ্টিতে আকৃতি অনেকটাই বিকৃত হয়ে গেছে। হারামের ভেতরের আঙিনাতে পৌঁছে অসংখ্য ঝরনার কাছে গিয়ে থামলেন শাহজাহান। পর্দা সরিয়ে তুলে নিলেন ঘুমন্ত মমতাজকে আর ধীরে ধীরে নিয়ে গেলেন ভেতরে।
.
১.৩
শাহজাহানের মাথার পাশ দিয়ে শিস কেটে চলে গেল বন্দুকের গুলি। নিজের যুদ্ধহাতির পিঠে বসে ঘুরে তাকালেন তিনি। উত্তপ্ত সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে হাত তুলে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন হঠাৎ শুরু হওয়া যুদ্ধদৃশ্য। একটু পরেই আরেকটা গুলি এসে লাগল হাতির কানের পিছনে বসে থাকা মাহুতের গলায়। আস্তে করে পাশ ফিরে পড়ে গেল লোকটা। রক্ত ছুটছে ফিনকি দিয়ে ক্ষত থেকে, পাথুরে ভূমিতে গিয়ে শায়িত হল মাহুত। শুড় তুলতেই গতি কমে গেল হাতির, ভয় পেয়ে মাথা নাড়তে শুরু করল এপাশ-ওপাশ।
নিজের হাওদার পার্শ্বদেশ ধরে স্থির হতে চেষ্টা করলেন শাহজাহান। দ্বিতীয় মাহুত দ্রুত উঠে এসে কথা বলতে লাগল হাতির ডান কানে। শান্ত হও, শান্ত হও এরপর কাঁধের উপর বাড়ি মারল লোহার রড দিয়ে। নিশ্চিন্ত হয়ে লাল বর্ণের শুড় নিচে নামিয়ে আনল হাতি।
চারপাশে পুরো যুদ্ধসারি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। গুলি বহনকারীরা নিজেদের ঘোড়া থেকে নেমে ব্যারেলে বারুদ ঢুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিল। একটু দূরে শাহজাহানের হাতির সামনে একজন নিম্নপদস্থ সৈন্য সবুজ টিউনিক পরনে চিৎকার করে নিজের ছোট্ট পদাতিক বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে শৃঙ্খলিত হবার জন্য। আরো একবার গোলার গর্জন শুনতে পেলেন শাহজাহান। আর ভেঙেচুরে পড়ে গেল দুজন পদাতিক সৈন্য। একজন মুহূর্তের মাঝে স্থির হয়ে গেল। অন্যজন এলোমেলোভাবে শুয়ে পা নাড়তে লাগল। তার একজন সঙ্গী, বয়স্ক দাড়িওয়ালা সৈন্য সাহায্য করতে এগিয়ে আসার পর নিজেও গুলি খেলো। পড়ে গেল সঙ্গীর দেহের উপরেই।
চারপাশ জুড়েই শব্দ আর বিশৃঙ্খলা। এখনি তাকে কিছু একটা করতে হবে। নতুবা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, ভাবলেন শাহজাহান। আর এরকম কিছু করতে হলে হাতি থেকে নেমে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে এগোতে হবে। তাই মাহুত কতক্ষণে হাতিকে হাঁটু গেড়ে বসাবে সেই জন্য অপেক্ষা না করে, রত্নখচিত হাওদার একপাশে গিয়ে মাটিতে নেমে গেলেন। আঘাত ঠেকাতে ভাজ করে নিলেন নিজের হাঁটু। হালকা পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কর্চিকে চিৎকার করে আদেশ দিলেন, আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। কিন্তু তার আগেই ধুলা আর গুলির ধোঁয়ার মাঝে উদয় হল একদল ঘোড়সওয়ার, শাহজাহানের সামনের পদাতিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। সবুজ পোশাক পরিহিত সেনাপতির উৎসাহে পদাতিক সৈন্যরা নিজেদের ভূমি ছাড়ল না। সেনাপ্রধানের আদেশে সকলে ভি আকৃতি করে এগোতে লাগল। ঘোড়সওয়ারের দল কাছে এগিয়ে আসতেই সম্ভবত বিশ জনের একটা দল–বাকিদেরকে ফেলে সামনে এগিয়ে এলো ঘামে ভেজা ধূসর যুদ্ধঘোড়র উপর বসে থাকা কৃশকায় দেহের তরুণ। শিরস্ত্রাণবিহীন মাথায় লম্বা চুল উড়ছে পেছন দিকে।
ভি আকৃতির মাথায় থাকা সৈন্য যদিও শক্তভাবেই নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে, তারপরেও কাঁপা কাঁপা হাতে বর্শা ছুঁড়ে মারায় লাগাতে পারল না বিজাপুরের সৈন্যের গায়ে। আক্রমণকারীর ধূসর ঘোড়া সাথে সাথে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। ঘোড়ার খুড়ের নিচে পড়ে ফেটে গেল মাথার খুলি। এ সময় তার পিছনে আর বাম দিকে থাকা সৈন্যরা এগিয়ে এলো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। এরপর সাবধানে হাঁটু গেড়ে থাকা অবস্থায় বর্শা ছুঁড়ে মারল। যেমনটা চেয়েছিল এবার ঠিক সেভাবেই বিধে গেল ঘোড়ার গলায়। সাথে সাথে পড়ে গেল জটা, আরোহী বহু দূরে উড়ে গিয়ে মাথা গেড়ে পড়ল মাটিতে। নিজের রক্ত আর মগজের মাখামাখি চুল নিয়ে পড়ে রইল বিজাপুরের আগম্ভক সৈন্য।
তাঁর নিজের ঘোড়া কোথায় গেল? চারপাশে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন বাদামি রঙা তৈজী ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে আসছে কর্চি। দ্রুত ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে উঠেই দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন, আমাকে অনুসরণ করো। তলোয়ার বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেলেন পদাতিক সৈন্যদেরকে ঘিরে ফেলা শত্রু ঘোড়সওয়ারদের দিকে। আক্রমণকারীদের একজন সর্বশক্তি দিয়ে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ভয় পাইয়ে দিল শাহজাহানের ঘোড়াকে। ফলে খানিকটা পিছনে হেলে গেলেন তিনি। আরেকজন ঘোড়সওয়ার লম্বা বল্লম নিয়ে নিজের কালো ঘোড়াকে ঘুরিয়ে এগিয়ে এল শাহজাহানের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বন্যপশুর মত আক্রমণ করল সম্রাটকে। কিন্তু বেঁচে গেলেন শাহজাহান তবে তিনি ভুল করলেন না। নিজের তলোয়ার দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন শত্রুর বাহুতে। নিজের বল্লম ফেলে দিয়ে ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল আক্রমণকারী সৈন্য, একই পথে এগিয়ে আসছিল তার সঙ্গী। উদ্যত ঘোড়াকে থামাতে পারল না সে ও; ফলে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল দুটি ঘোড়াই, সাথে তাদের আরোহীরা।
তৃতীয় আরেকজন ঘোড়সওয়ার মাথার উপর বন্যভাবে বাঁকানো ভোজালি ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে এলো শাহজাহানের দিকে। একেবারে সময় মত সাবধান হয়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন শাহজাহান। প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া করলেন তিনি। তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে নিজের ভোজালি দিয়ে আঘাত প্রতিহত করে দিল তৃতীয় সৈন্য। আবারো চেষ্টা করলেন শাহজাহান। এবার তলোয়ার গিয়ে আঘাত করল সৈন্যটার পেটে। পড়ে গেল লোকটা। এরপর চারপাশে তাকিয়ে সম্রাট দেখতে পেলেন বাকি আক্রমণকারী ঘোড়সওয়াররা ঘুরে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে চলে যাচ্ছে–যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই।