উদ্বিগ্ন হয়ে আর রাজার চেহারায় সংবাদের কোন প্রতিচ্ছায়া দেখতে না পেরে নিয়ম ভেঙে কথা বলে উঠল দারা। আপনার নিয়ে আসা সংবাদ কি ভালো না খারাপ, জয় সিং?
খানিকটা বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল রাজা, মিশ্র, সম্মানীয়।
ঠিক আছে, দারা। বলে উঠলেন শাহজাহান। যেভাবে ঘটেছে সেভাবেই ঘটনাসমূহকে বর্ণনা করতে দাও জয় সিংকে, যেন আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি।
আমি তাই করছি, জাহাপনা। সম্রাটকে কুর্নিশ করলো রাজা, শাহজাহানের শব্দগুলোতে স্পষ্ট বুঝতে পারল ভৎর্সনা করা হয়েছে অতি আগ্রহী পুত্রকে।
প্রথমে যমুনা তারপর গঙ্গা ধরে দ্রুত এগিয়েছিল আমাদের জাহাজ বহর। মাঝে মাঝে শুধু থামা হয়েছে ঘোড়াদের অনুশীলনের জন্য। আর আল্লাহবাদে থামা হয়েছিল আরো অস্ত্র ও রসদ নিয়ে দিলীর খানের যোগ দেয়ার জন্য। এক মাসেরও কম সময়ে পাঁচ শত মাইল অতিক্রম করেছিল বহর, এরপর স্থানীয় এক প্রজার নিয়ে আসা তথ্যানুসারে, যে কিনা নিজের নদীর কাছাকাছি দুর্গ থেকে দাঁড় বেয়ে এসেছে আমাদের সাথে যোগ দিতে আপনার দৌহিত্র বারানসীর কাছে যাত্রা স্থগিতের আদেশ দেয়। এক্ষেত্রে আমার এবং দিলীর খানের পরামর্শ মতই কাজ করেছে শাহজাদা সুলাইমান। কয়েকটা ভারী যন্ত্রপাতি পেছনে রেখে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যায় শাহ সুজা আর তার সৈন্যদের মোকাবেলা করতে। প্রজার দেয়া তথ্যানুযায়ী শাহ সুজা ও তার বাহিনী পশ্চিম দিকে বারো মাইল ভেতরে নদীর উত্তর অংশ ধরে এগোচ্ছে।
পরের দিন সন্ধ্যার পরে তাঁবুতে ফিরে আসলো আমাদের কয়েকজন চর। প্রধান সেনাবাহিনীর আগে গিয়ে চারপাশ ভালোভাবে তদারকি করে আসার সময় শিবিরে আগুনের আলো জ্বলতে দেখেছে। ঘোড়া থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে শাহ সুজার তাঁবু একেবারে নীরব দেখতে পায়; এমনকি একজন পাহারাদারও ছিল না। তাদের প্রতিবেদন শুনে যুদ্ধসভার মাধ্যমে মধ্যরাতের ঠিক পরপরই শাহ সুজার শিবিরে আক্রমণের ব্যাপারে একমত হয়ে যাই–আমরা সকলে, কেননা তখন আগত দিনের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করবে শাহ সুজার সৈন্যরা। পরিবারের রক্তে রঞ্জিত না হতে চাওয়া আপনার আদেশের কথা স্মরণ করে, শাহজাদা সুলাইমান আমাদেরকে গুলি ছুঁড়তে নিষেধ করে দেয়। হত্যা না করেই শাহ সুজাকে খুঁজে বের করাটাই ছিল উদ্দেশ্য।
শাহ সুজার তাঁবুর কাছাকাছি এক মাইলের কম দূরত্বের মাঝে ছোট ছোট ঝোঁপের কাছে যাবার আগপর্যন্ত সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই যন্ত্রণাকাতর এক চিৎকারে কেঁপে ওঠে বাতাস আর আমাদের পথ প্রদর্শক দূত ছিটকে পড়ে ঘোড়া থেকে। তার ভয়ার্ত ঘোড়া আমাদের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। লাগাম মাটিতে লুটোচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম, দেখতে পাইনি এমন কোন পাহারাদার হয়ত চরের গায়ে গুলি করেছে। কিন্তু ঘোড়া কাছে আসতেই দেখা গেল জটার নিতম্বে রক্তাক্ত আঁচড়, আমাদের সারির মধ্য দিয়ে দৌড়ে চলে যেতে লাগল পেছনে বিশাল বড় একটা পুরুষ বাঘ। আমাদের ঘোড়াগুলোও বেসামাল হয়ে উঠল। বাঘটাই ছিল চরের চিৎকার আর ঘোড়র ক্ষতের কারণ–শত্রু আক্রমণ নয়। কিন্তু আমাদের সংখ্যা দেখে আবারো রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল বাঘ। কিন্তু হট্টগোলের শব্দে জেগে গেল শাহ সুজার কয়েকজন প্রহরী। সতর্ক হয়ে চিৎকার শুরু করে দিল তারা।
তৎক্ষণাৎ ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁবুর দিকে ছুটে গেলাম আমরা, হাতে বর্শা আর খোলা তলোয়ার। সবচেয়ে কাছের তাঁবুগুলো হয়ত আর একশ গজও দূরে নয়, এমন সময় ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি কামানের গোলা উড়ে আসতে লাগল আর ঘোড়া থেকে পড়ে গেল একজন কর্চি। তাঁবুগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে প্রথমেই তলোয়ার দিয়ে দড়ি কেটে দেয়া হল; ফলে তবু ছিঁড়ে নিচে চাপা পড়লো সৈন্যরা। বর্শা দিয়ে গেঁথে ফেলা হল আটকে পড়া সৈন্যদেরকে। রক্তে ভিজে গেল তাঁবুর কাপড়, আহত সৈন্যরা চিৎকার করে উঠল আত্মসমর্পনের জন্য। পনের মিনিটেরও কম সময়ে তাঁবুর ঠিক মাঝ বরাবর ঢুকে গেলাম আমরা। তখনি দেখতে পেলাম অশ্বারোহীদের বড়সড় একটি দল ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পূর্বের জঙ্গলে। চিৎকার করে শাহজাদা সুলাইমানকে জানালাম যে এদের মাঝে শাহ সুজাও নিশ্চয় আছে; কিন্তু তাদেরকে চলে যেতে দেবার কথার উত্তরে জানালো শাহজাদা… আমরা তাদেরকে পরে দেখে নেব। সেই মুহূর্তের জন্য জরুরি ছিল শাহ সুজার বাকি সৈন্যদের ব্যবস্থা করা। তাঁবুতে মূল্যবান সব জিনিস ছিল। এগুলোর মাঝে রাজকীয় যুদ্ধহাতিও ছিল যেগুলোকে কাজে লাগাবার সুযোগ পায়নি শাহ সুজা।
আমার পুত্র কি তাহলে পালিয়ে গেছে? যদি না হয়, তাহলে কী হল?
আমার বিশ্বাস শাহ সুজা পালিয়ে গেছে, জাহাপনা; কিন্তু আমি নিশ্চিতও নই। আর কোথাও শাহ সুজাকে ধরতে পারিনি আমরা-মৃত বা আহতদের মাঝেও ছিল না। শাহজাহানের চেহারা দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠল জয় সিং।
কিন্তু এসব তো ভালোই সংবাদ? তোমার দিকনির্দেশনায় শাহ সুজাকে পরাজিত করেছে সুলাইমান।
হ্যাঁ, জাহাপনা, কিন্তু তারপর যা ঘটল সেটা দুঃসংবাদ।
তোমার কথার অর্থ কি শাহ সুজার দল পুনরায় একত্রিত হয়ে আক্রমণ করেছে?
না, জাহাপনা, তা নয়–সহজ কথায় বলতে গেলে আপনার দৌহিত্র জেদ করেছে যেন শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করি আমরা, যারা পূর্ব দিকে পাটনাতে পালিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। দিলীর খান আর আমি বহুবার বোঝাতে চেয়েছি যে শাহ সুজা ইতিমধ্যেই আপনার সিংহাসনের জন্য বিদ্রোহ শুরু করেছে আর জানামতে আওরঙ্গজেব আর মুরাদকেও এখনো পরাজিত করা সম্ভব হয়নি, তাই এটাই এখন সবচেয়ে বড় হুমকী। আমরা চেয়েছি সেনাবাহিনীকে, যেটি কিনা সৈন্যদের সেরা অংশ, পিছিয়ে এসে পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে, সেখানেই জরুরি বেশি। শাহজাদা সুলাইমান কিছুতেই একমত হয়নি। কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে তার কথা মান্য করতেই হবে। আমি শুধু অনুমতি নিয়ে আগ্রাতে ফিরে এসেছি ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের নিয়ে, যেন আপনার কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে পারি আর দিলীর খান রয়ে গেছে উপদেষ্টা হিসেবে।