যদি সত্যিই শাহজাদা মুরাদ নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে থাকে তাহলে তো আওরঙ্গজেবের সাথে যুদ্ধ করার কথা, যোগ দেবার নয়, তাই না? জানতে চাইল মারওয়ারের রাজা যশয়ন্ত সিং। আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছে কোমরের কাছে স্বর্ণের চেইনের সাথে ঝুলানো ছুরির রত্নখচিত খাপের মাঝে।
আমার তা মনে হয় না। আমাদের দূতেরা উত্তরে আহমাদাবাদের দিকে যাবার সময় ধরে ফেলেছে আওরঙ্গজেবের এক বার্তাবাহককে। লোকটা আওরঙ্গজেবের সীল লাগান পত্র মুরাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। কি লেখা ছিল, আমি পড়ে শোনাচ্ছি! ইশরায় পরিচারককে ডেকে পত্রখানা তুলে নিলেন শাহজাহান।
‘সিংহাসন দখলের জন্য আমাদের পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। ইসলাম আর মোগলদের উপর কলঙ্ক লেপন করা প্রতিমা পূজারী আর অবিশ্বাসীদেরকে একসাথে খতম করে এই পাপময় দেশে এক আল্লাহ তায়ালার নাম কায়েম করব। আমার প্রিয়তম ভাই, আমার সাথে এই মহতী কর্মে অংশ নিয়েছ তুমি আর তাই এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করছি যে, যখন আমরা সফল হব–সফল হবই, কেননা আমাদের অভিপ্রায় সৎ–তোমার পুরস্কার হবে পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মির আর সিন্দু প্রদেশ, যেখানে কারো কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া আপন শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে তুমি। আল্লাহ আমার স্বাক্ষী রইলেন। যখন একসাথে দেখা হবে, যেমন আমরা ঠিক করে রেখেছি আগ্রায় পৌঁছানোর আগে শত্রুকে পদানত করা ও এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সফলভাবে সম্পাদনের জন্য বাকি আলোচনা সার হবে।‘
এমনো হতে পারে যে আমার হাতে পৌঁছে এ পত্র আমাকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এই চক্রান্ত করা হয়েছে। এরকম অসদোপায় অবলম্বন আওরঙ্গজেবের দ্বারা সম্ভব। কিন্তু আমার মনে হয়। এটা মিথ্যে নয়। মুরাদের বৃথা অহমিকা আর অন্তঃসারশূন্যতার সুবিধা নিচ্ছে আওরঙ্গজেব। সে জানে যে আগ্রা থেকে মুরাদের দূরত্ব কম। আর আমার সন্দেহ যৌথ বাহিনীর উপর আওরঙ্গজেব জোর দিচ্ছে যে তার আগে মুরাদ যেন এখানে পৌঁছে কোন ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক সুযোগ না নিতে পারে। শাহ সুজার প্রতি আওরঙ্গজেবের কী মনোভাব সেটা শুধুমাত্র অনুমান। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে মুরাদ বা আওরঙ্গজেব কাউকেই আগ্রাতে পৌঁছাতে দেয়া যাবে না। আর তাই রাজা যশয়ন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণে আরো একদল সেনাবাহিনী পাঠাতে চাই আমি, যেন তাদেরকে খুঁজে বের করে প্রতিহত করা যায়। একাকী বা যৌথ যেভাবেই তাদেরকে পাওয়া যাক না কেন। আল্লাহ্ আর ন্যায় আমাদের পাশে আছে–তাদের সাথে নয়।
চুপ করে বসে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললেন শাহাজাহান। দারা জানে যে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। ক্রমাগত দুর্বলতা সত্ত্বেও রাতের বেশিভাগটাই জেগে বসে দারা। সুলাইমান, জয় সিং, যশয়ন্ত সিং আর অন্যান্য সেনাপ্রধানদের সাথে মানচিত্র দেখেছেন, রসদের ব্যাপারে কথা বলেছেন–যাত্রার জন্য কত সৈন্য প্রস্তুত আছে, পরবর্তী দল পাঠাতে কত সময় লাগবে, হাতে থাকা কামানের সংখ্যা কত, কতটি যুদ্ধতি আছে রাজকীয় হাতিশালে আর কতটাই বা দিতে পারবে রাজপুত মিত্রেরা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও অসুস্থ শয্যায় পড়ে থাকতেন শাহজাহান আর এখন কৃশকায় দুর্বল শরীরে যদিও কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই, তাঁর ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতা অন্যদের মাঝে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করছে। উপদেষ্টাদের চোখেমুখে তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে দারা। নিজের ভেতরেও তা বেশ অনুভব করতে পারছে।
উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলল শাহজাদা। দীর্ঘজীবী হোন আমার পিতা, ম্রাট, জিন্দাবাদ বাদশা শাহজাহান।
চারপাশে উপদেষ্টাদের উল্লসিত প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে তার নিজের উৎসাহও হয়ে গেল দ্বিগুণ। যেমনটা পিতা বলেছেন, তাদের অভিপ্রায় সৎ।
*
আব্বাজান, রাজা জয় সিং এসেছেন। ঘুমের মাঝে দারার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন শাহজাহান। সুস্থ হয়ে যাবার পরেও মধ্যাহ্নের খাবারের পরে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন খানিকটা–যদিও আগের তুলনায় তেমন খেতেও পারেন না। শুধুমাত্র তন্দুরে সেকা খানিকটা মুরগি আর অল্প একটু জাফরানী ভাত। চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে সোনালি রেশমের কাউচের উপর উঠে বসলেন শাহজাহান, এর উপরে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দ্রুত মনোযোগ দিলেন বাস্তবে। গত কয়েক সপ্তাহে তেমন একটা সংবাদ পাননি সুলাইমানের সেনাবাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে। কী সংবাদ এনেছে জয় সিং? কেন বা সে নিজে এলো?
আমি এখনো জানি না। এখনো তাকে দেখিনি। হারেমে নাদিরার সাথে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এমন সময় একজন পরিচারক এসে জানালো রাজার আগমন সংবাদ। ভেবে দেখছি দুজনে একসাথে তার সংবাদ শুনলেই ভালো হবে। খবর পাঠিয়ে দিয়েছি যেন পনের মিনিটের মাঝে ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের কক্ষে এসে দেখা করেন আমাদের সাথে।
বস্তুত মাত্র দশ মিনিটের মাথাতেই পিতা-পুত্রের সামনে রাজার আগমন ঘোষণা করল এক কর্চি। রাজা প্রবেশ করতেই দেখা গেল সবসময়কার মতই ভাবে রুচিশীল পোশাকে হাজির হয়েছেন; যার জমকালো গোঁফ নিপুণভাবে বাঁকানো আর সুগন্ধি তেল চর্চিত, ঘিয়ে রঙা আলখাল্লায় একটিও দাগ নেই। পাশে একটি কক্ষে বসে প্রাণপণে ময়ূরের পাখা দিয়ে তৈরি বিশাল পাখা টানছে পরিচারকেরা। সম্রাটের মাথার উপরে কোন এক অতিকায় প্রজাপতির পাখার মত করে আগুপিছ হয়ে বাতাস ছড়াচ্ছে এই পাখা। তারপরেও গরম আর গুমোট হয়ে আছে। কক্ষ, অথচ জয় সিং একটুও ঘামছে না!