আর বিপদ, মনে হচ্ছে অবশেষে এসেই গেছে… মানুষের ভিড়ের মাঝে বহুকষ্টে দরজার কাছে নিজেকে ঠেলে দিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে শহরের দেয়াল আর প্রভাতের ধূসর আলোয় ধোঁয়া আর ধুলা দেখতে পেল নিকোলাস। হঠাৎ করেই খানিকটা পরিচিত এক তরুণ ব্যবসায়ীর নজরে এলো। চামড়ায় মোড়ানো হিসেবের খাতা বুকের কাছে ধরে দৌড়ে আসছে তার দিকে। জন, কী হয়েছে? হট্টগোল ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল নিকোলাস।
শুনতে পেল না তরুণ ব্যবসায়ী, পেশীবহুল হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল নিকোলাস। আমি নিকোলাস, তুমি জানো কী হচ্ছে আসলে? ডাকাত পড়েছে? প্রশ্নটা করলেও নিকোলাস ভালো করেই জানে যে ডাকাতেরা শহরের বাইরে রসদবাহী রেলগাড়িতে আঘাত করতে পারলেও কামান কোথায় পাবে তাও এত বড় কামান?
কেউ কেউ বলছে যে শাহজাদা মুরাদ তুর্কী ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে এসেছে সুরাট আক্রমণ করতে।
কিন্তু সে তো গুজরাটের শাসনকর্তা। কেন তাহলে গুজরাটের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহরের উপর অতর্কিত হানা দিয়েছে–এই শহরই তো তাকে সবচেয়ে বেশি কর দেয়? নিকোলাসের হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে তরুণ ব্যবসায়ী, বিবর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে বিপদ থেকে দৌড়ে পালিয়ে দুর্গের কাছে একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ধাক্কা দিয়ে এগোতে থাকা ভিড়ের জনতার দিকে।
কারণ শাহজাদা কোম্পানির কাছে বিশাল অঙ্কের ঋণ চেয়েছিল; কিন্তু বোর্ডের ডিরেক্টরেরা প্রত্যাখান করেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল তরুণ ব্যবসায়ী, বুঝতে পারল তাকে আরো জোর করে আঁকড়ে ধরেছে নিকোলাস।
তো এখন এভাবেই নিজের কার্য উদ্ধার করতে চাইছে…হাত ছেড়ে দিল নিকোলাস আর জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল লোকটা। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল নিকোলাস। তার নিজেরও কি এখন দুর্গের আশ্রয়ে ঢাকা উচিত?
এখন তো আর সে কোন মোগল সেনাপ্রধান নয়, শুধুমাত্র একজন, বিদেশী যে কিনা গৃহে ফেরার সময় জড়িয়ে পড়েছে আরেকজনের সমস্যাঁতে। নিজেকে রক্ষা করাই তার প্রধান দায়িত্ব। সত্যিই তাই? যদি মুরাদ সত্যিই সুরাটের উপর আক্রমণ করে থাকে তাহলে অরাজকতা শুরু হয়েছে বলতে হবে। শাহজাহান কখনোই এমন কিছুর অনুমতি দেবেন না; তার মানে গুজবগুলো সত্য: সম্রাটের পুত্রেরা, অন্তত মুরাদ তো বটেই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছে।
দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে ভয়ার্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে আবারো সরাইখানার দিকে ফিরে চলল নিকোলাস; ইতিমধ্যেই সেখানকার সবাই পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঘুমন্ত প্রহরী উধাও হয়ে গেছে, জীবনের চিহ্ন বলতে শুধুমাত্র বিছানার নিচে শুয়ে আছে লোম-ওঠা একটা কুকুর, সামনের পায়ের মাঝে মাথা গুঁজে ভয়ে কুইকুই করছে, অবিরাম চলছে গোলাবর্ষণ।
নিজের কক্ষে গিয়ে খড়ের তোষকের নিচে থেকে ব্যাগ দুটো তুলে নিল নিকোলাস। তেমন একটা ভারী নয়–হিন্দুস্তানে এতদিনের সেবাদানের ফসল–কিন্তু এ ভূমির কাছে এখনো ঋণী সে, জানে কোথায় যেতে হবে।
*
রাজকীয় সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করার মত যথেষ্ট সময় নেই হাতে; কিন্তু বিলম্ব করাটা কোন উপায় নয়, আবারো উপদেষ্টামণ্ডলীর সভা ডেকে প্রস্তুতি নিতে বলবেন ভাবলেন শাহজাহান। তার মতে, উপদেষ্টারাও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে–সবাই পঞ্চাশের নিচে বলতে গেলে কেউই নেই। তিন সপ্তাহ আগে সংকট শুরু হবার পর প্রথমবারের মত দারার সামরিক অভিজ্ঞতা না থাকাটার জন্য অনুতাপ করলেন শাহজাহান। সবসময় নিজের পাশে, বিপদ আপদ থেকে মুক্তভাবে রাখতে চেয়েছেন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। কখনো ভাবেননি এতে করে অন্য পুত্রেরা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে যা কোনদিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর এবং দারার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে।
আমার বিশ্বস্ত সভাসদগণ, বার্তাবাহক আর দূত মারফত জানতে পেরেছি যে শাহসুজার বাহিনী এখনো গঙ্গা ধরে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে, ধীরে হলেও এগিয়ে আসছে। শুরু করলেন সম্রাট। যেসব ভূমি পার হয়ে আসছে, তাদেরকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি যেন শাহ সুজার বাহিনীকে থামিয়ে দেয়ার জন্য সবরকম চেষ্টা করা হয় ও রসদ সংগ্রহ করতে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য সেনাবাহিনীই প্রয়োজন। তাই শাহ সুজার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি আমি। আমার দৌহিত্র, দারাপুত্র সুলাইমান নেতৃত্বদান করবে, আম্বারের রাজা জয় সিং থাকবে পরামর্শদাতা। বাহিনীতে থাকবে বিশ হাজার অশ্বারোহী ও পাঁচ হাজার পদাতিক সৈন্য। গঙ্গার নিচে বরাবর গেলে আফগান জেনারেল দিলীর খান ও তার বাহিনী যোগ দেবে এ বাহিনীর সাথে।
শাহ সুজাকে কি জীবন্ত নিয়ে আসতে হবে? জানতে চাইল রাজা।
হ্যাঁ। পুত্রের রক্তপাত এড়িয়ে যেতে চাই। আমার অভিপ্রায় নিজের অপরাধ কবুল করার জন্য আমার সামনে নিয়ে আসা হবে তাকে।
আপনার অন্য দুই পুত্রের কোন সংবাদ, জাহাপনা? জিজ্ঞেস করে উঠল উজবেক খলিলুল্লাহ খান, যার ক্ষত-বিক্ষত মুখমণ্ডল বহন করছে উত্তরের অভিযানে আওরঙ্গজেবের পাশে থেকে নিজের দেশীয় ভাইদের বিরুদ্ধে শক্ত যুদ্ধ করার চিহ্ন।
মুরাদের বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্যগুলো এখনো অস্পষ্ট। কোন কোন সংবাদে বলা হয়েছে যে নিজেকে গুজরাটের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছে সে–মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হচ্ছে আর মুদ্রায় নিজের শাসনামলের চিহ্ন খোদাইয়ের আদেশও নাকি দিয়েছে। এছাড়া অন্য সংবাদ বলছে নিজের রাজস্ব মন্ত্রীকে হত্যা করেছে–আলী নকি, যে কিনা সবসময় বিশ্বস্ত ছিল আমার প্রতি মুরাদের ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সমালোচনা করার অপরাধে। সংবাদে শুনেছি মুরাদ নিজে নাকি তাকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়াও গুজব আছে মুরাদ সুরাট আক্রমণ করে লুট করার পাঁয়তারা করছে; এরপর যুদ্ধের ব্যয় বহন করার মত অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেলে নিজের রাজধানী আহমেদাবাদ থেকে রওনা দিবে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা আওরঙ্গজেবের সাথে হাত মিলাতে। এরই মাঝে নিজের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েদেরকে চম্পনীর দুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে, তার মানে দীর্ঘ অভিযানের পরিকল্পনা আছে।