আশা করি আমি খুব বেশি বড় কোন পাপ করিনি। আমি জানি যে অনেক ভুল কাজ করেছি আর অন্য অনেকর চেয়ে বেশিবার করেছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে এগুলোর কারণ আমার উচ্চাকাঙ্খ আর অবস্থান অনেকের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে। এমন নয় যে অন্তরের দিক থেকে বেশি পাপাচারী ছিলাম। যা করেছি তা করেছি আমার স্ত্রী, সন্তান আর রাজপরিবারের প্রতি ভালোবাসার জন্য।
আমাদের কেউই আপনার ভালোবাসা নিয়ে সন্দিহান নয়, আব্বাজান। আল্লাহ আপনাকে সকল পাপের জন্য ক্ষমা করবেন। এখানে পৃথিবীতে আমাদের মায়ের জন্য যে সমাধি নির্মাণ করেছেন আপনি, তা আপনার মহৎ ভালোবাসার অতুলনীয় উদাহরণ হিসেবে অন্য সব স্মৃতিকে ছাপিয়ে বেশি দিন টিকে থাকবে। জাহানারা শুনতে পেল অনিয়মিত হয়ে পড়ল পিতার হৃদস্পন্দন। আরো শক্ত করে ধরল পিতার হাত, বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন শাহজাহান। শীঘি বেহেশতের উদ্যানে মায়ের সাথে মিলিত হবেন আপনি।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাকে। যমুনার কুয়াশা ভেদ করে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠলেন শাহজাহান। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল নাড়ীর গতি। বুঝতে পেরেই পিতার উপর ভেঙে পড়ল জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা। উষ্ণ অশ্রুতে পিতাকে ভরিয়ে দিয়ে কাঁদতে লাগল তাঁর স্ত্রী, জীবিত আর মৃত ছেলেমেয়ে– এমনকি তার নিজের জন্যও।
এক কি দুই মিনিট পরে পিতার মৃতদেহ আস্তে করে ডিভানে শুইয়ে দিল জাহানারা। উঠে দাঁড়াল, নিজেকে শান্ত করে, শিরদাঁড়া খাড়া করলেন। নিজেকে মনে করিয়ে দিলেন যে সে একজন মোগল। পিতার জন্য তাঁর প্রাপ্য সমাধির আয়োজন করতে হবে। যদি তিনি নিজের জন্য কালো মার্বেলের সমাধি নাও পেয়ে থাকেন স্ত্রীর সাথে সেই অত্যুজ্জ্বল শুভ্রতায় একত্রিত হতে পারবেন, যে স্তম্ভ তিনি নির্মাণ করেছেন। স্ত্রীর জন্য, তাদের ভালোবাসার জন্য।
২.৭ খড়ের বিছানার উপর শুয়ে
২.৭
খড়ের বিছানার উপর শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের আশায় এপাশ ওপাশ করতে লাগল অশান্ত নিকোলাস ব্যালান্টাইন। আর মাত্র তিন দিনের মাঝেই সুরাট থেকে ব্রিস্টলের উদ্দেশে যাত্রা করবে জুনো। জাহাজের কার্গো ভর্তি হয়ে আছে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মোটাসোটা লাভ এনে দেবার আশায় ছাপানো সুতীর কাপড়, সিল্ক আর নীল দিয়ে। নিকোলাস নিজেও বিদেশ পাড়ি জমাবে। জুনোতে জায়গা পাবার জন্য ভালোই অর্থ দিতে হয়েছে লালমুখো ক্যাপ্টেনকে। কিন্তু উত্তমাশা অন্ত রীপা ঘুরে যে দেশে পৌঁছাতে চাইছে, যেটিকে সে আদৌ গৃহ বলে মনে করে না, সেই দীর্ঘ আর বিপদসংকুল ভ্রমণের যাত্রাপথ যে আনন্দময় হবে না তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
নিদ্রার আশা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। আর মাত্র ঘণ্টাখানেকের মাঝেই দেখা দেবে প্রভাত, অথচ সরাইখানার নিচ তলার ছোট্ট কক্ষের কাদামাটি দিয়ে তৈরি ইটের দেয়াল থেকে এখনো গরম ভাপ বের হচ্ছে। নিকোলাসের প্রায় উলঙ্গ দেহ ভিজে গেছে ঘামে। বাইরের আঙিনাতে গিয়ে কুয়ো থেকে এক বালতি পানি তুলে নিজের গায়ে ঢেলে দিল। কুকুরের মত ভিজে গায়ে এগিয়ে গেল নিম গাছের ছায়ার নিচে বসতে। কাছেই একটা চারপেয়ে টুলের উপর বসে আছে– সম্ভবত নৈশ প্রহরী–ঘুমন্ত একজন মানুষ। যাক, অবশেষে শাহজাদী জাহানারাকে নিয়ে আর কোন চিন্তা রইল না। আগের দিন হাতে এসে পৌঁছানো সংক্ষিপ্ত চিঠিটা শান্তি এনে দিয়েছে মনের মাঝে, আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যাবার ব্যাপারে দূর হয়ে গেল সব অপরাধবোধ।
বেশ শক্ত ধাঁচের মেয়ে জাহানারা। শিখে নিতে হয়েছে এমনটা, ছোট্টবেলাতে জাহাঙ্গীরের হাত থেকে পালাতে হয়েছিল পরিবারসহ। একই সাথে মন খারাপ হয়ে গেল কল্পিত অপরাধের বোঝা তার উপর চাপানো হয়েছে শুনতে পেয়ে, যদি সুরাটের ব্যবসায়ীদের মাঝে ছড়ানো রটনাগুলো সত্যি হয়ে থাকে। কিন্তু সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্রেরা কি সত্যিই বিদ্রোহে জড়িয়েছে? বিশদভাবে কিছুই লেখা ছিল না জাহানারার চিঠিতে। কিন্তু ভাগ্যে যাই থাকুক না কেন আবারো দারা আর পিতার পাশে থাকতে পেরে নিজের স্বস্তি প্রকাশ করেছে শাহজাদী। এতে কি যাত্রাপথে তাকে শঙ্কিত না হবার জন্য প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে? সম্ভবত না। হতে পারে যে দারার ভাইয়েরা শুধুমাত্র আস্ফালন করছে। এই বিশাল দেশে, রাজকীয় ট্রাঙ্ক রোড আর বার্তা বাহকেরা ব্যতীত সংবাদ পৌঁছায় অতি ধীর গতিতে। প্রায় বিকৃতি লাভ করে পথিমধ্যে আর বোকার দলও অভাব নেই তা বিশ্বাস করার।
ভেতরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল নিকোলাস কিন্তু শুনতে পেল কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ, অনুভব করল কেঁপে উঠল মাটি। এক কি দুই মিনিট পরে আবারো শুরু হল আওয়াজ, এবার আর বন্ধ হবার নাম নেই। এটা একমাত্র কামানের গোলাই হতে পারে। সুরাটে আক্রমণ চালানো হচ্ছে? শব্দের গতিপথ শুনে বোঝা গেল যে গ্রামের দিক থেকে শহরের উপর গোলা ছোঁড়া হচ্ছে। পাশের রাস্তা থেকে হতচকিত চিৎকার শোনা গেল। দৌড়ে নিজের কক্ষে গেল নিকোলাস। তাড়াহুড়ো করে শার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে পাশের গলিতে গিয়ে দেখল ইতিমধ্যে বেশ লোকজন জড়ো হয়ে গেছে-ইংরেজ ব্যবসায়ীরা, কারো কারো পরনে রাতের পোশাক। কারো হাতে ধরা ক্যাশ বাক্স; ভারতীয় কেরানী আর দোকানদার। নিশ্চয় দুর্গের নিরাপত্তার ভেতর যেতে চাইছে সকলে। মোটা দেয়াল দিয়ে তৈরি চতুর্ভুজ দুর্গ প্রায় এক মাইলের চারভাগের এক ভাগ দূরত্বে সমুদ্রের কাছাকাছি উচ্চভূমির উপর অবস্থিত। দুর্গের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টের গভীরে নিজেদের সম্পদ সঞ্চিত করে রেখেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উৎকৃষ্ট দুর্গের পাহারার দায়িত্বে আছে ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো কোম্পানি রেজিমেন্টের একদল সৈন্য। এর দেয়ালের নিচে পুরোপুরি সজ্জিত, কামানসহ প্রস্তুত হয়ে নোঙ্গরে ভাসছে বেশ কয়েকটি জাহাজ যেন যে কোন অনাহূত বিপদের মোকাবেলা করা যায়।