চিঠিটা পড়তে গিয়ে অশ্রুতে ভরে গিয়েছিল জাহানারার চোখ। স্বস্তি পেয়েছে এই ভেবে যে, যাক অবশেষে নিজের ঠাণ্ডা, বৃষ্টিস্নাত দ্বীপে ফিরে যেতে পেরেছে নিকোলাস, কিন্তু প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবে যে লোকটা কি সত্যিই সুখী সেখানে গিয়ে? বিমর্ষতা আর অপূর্ণ আশা তো জীবনেরই অংশ, যেই হোক না কেন শাহজাদী অথবা নিকোলাসের মত অভিযাত্রী অথবা একেবারে নগণ্য গ্রামবাসী সবার বেলাতেই একই কথা খাটে।
*
হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল জাহানারার। শেষ দিকের শীতের প্রভাতের হালকা আলো এসে পড়েছে ঘরের মাঝে, গরাদের চারপাশে জটিল খোদাইকৃত কারুকাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গেল জাহানারা, তাকাল বাইরের কুয়াশার দিকে, বছরের এই সময় যমুনা প্রায়ই এভাবে ঢেকে থাকে। হঠাৎ করেই একটু কেঁপে উঠল মন, ঠাণ্ডাতে নয়, যদিও সকালটা বেশ ঠাণ্ডাই, কিন্তু কি যেন মনে হলো। এখনি পিতার কাছে যাওয়া দরকার, দুসপ্তাহ আগে জন্মদিনের পর থেকে শাহজাহানের শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেন এরকম বোধ হচ্ছে সে কথা না ভেবেই পরিচারিকাকে ডেকে দ্রুত পোশাক পরে নিল জাহানারা।
এক ঘণ্টার চার ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ের মাঝে গরম পোশাক পরে আর ওড়নার বদলে চেহারার উপর নরম কাশ্মিরি শাল জড়িয়ে ত্রস্তপায়ে পিতার কক্ষের দিকে ছুটল শাহজাদী। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল দুজন হারেমের নপুংসক আর অনুসরণ করল তার নিজের দুজন নারী ভৃত্য। গজদন্ত দিয়ে তৈরি দরজার কাছে পৌঁছে নপুংসকদ্বয় করাঘাত করল হাতে থাকা লাঠি দিয়ে, ভেতর থেকে দরজা খুলে যেতেই সরে দাঁড়াল জাহানারাকে প্রবেশ করতে দেবার জন্য।
আব্বাজান এখনো উঠেননি? রুপালি চুলের পাঠান, শাহজাহানের বয়স্ক প্রধান ভৃত্যের কাছে জানতে চাইল জাহানারা।
হ্যাঁ, মাননীয় শাহজাদী। বলতে শুরু করল লোকটা আর স্বস্তি ফিরে পেল জাহানারা। প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে জেগে গেছেন তিনি যখন আমরা নিত্যকার মত দেখতে এসেছিলাম তাঁকে। জানিয়েছেন যে তিনি উঠতে চান না, কিন্তু ঠিক তার কক্ষের বাইরে গম্বুজাকৃতি মঞ্চে নিচে বিছানা প্রস্তুত করে দিতে যেন বেশি সময় বিশ্রাম নিতে পারেন তিনি।
এখনো কি মঞ্চে আছেন?
হ্যাঁ মাননীয় শাজহাদী। শয্যা প্রস্তুত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমাদের। দশ মিনিট আগেও আমি আসার সময় আধো জাগরণে ছিলেন তিনি।
আমি তাঁর কাছে যাচ্ছি।
এখানো মনের মাঝে অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে দামি কার্পেটে মোড়া কক্ষ পার হয়ে বাইরের দিকের দরজা দিয়ে বারান্দার মত জায়টাতে গেল জাহানারা। রেশমের কুশন আর কোলবালিশে হেলান দিয়ে ডিভানে শুয়ে আছেন শাহজাহান। ভোরের ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই পেতে গায়ে জড়িয়েছেন শাল আর নরম উলের কম্বল। হালকা একটু বাতাস এসে মাথা ঢেকে রাখা নানা বর্ণের ছাপঅলা শালের নিচ থেকে বের করে দিল একগুচ্ছ রুপালি চুল, নিচু হয়ে আবারো শালের মাঝে কেশগুচ্ছকে ফেরৎ পাঠালো জাহানারা। প্রথমে মনে হল চোখ আধবোজা অবস্থায় জাহানারার স্পর্শ বা উপস্থিতি কিছুই টের পেলেন না শাহজাহান। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ জোড়া একটু একটু করে খুলে গিয়ে নিবদ্ধ হল দৃষ্টি।
জাহানারা তুমি?
জ্বি, আব্বাজান, পিতার হাত ধরল জাহানারা। কত নরম মনে হল দেহত্বক। হাতের তালু আর লম্বা আঙুল মাংস প্রায় নেই বললেই চলে।
ভালো। আমি খুশি হয়েছি।
এক বা দুই মুহূর্তের জন্য দুজনের কেউই কিছু বলল না। শাহজাহানের হালকা আর দ্রুত নিঃশ্বাস দেখে জাহানারা উপলব্ধি করল যে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভুল বলেনি। পিতার সাথে শেষ দেখা হবার পর গত কয়েক ঘণ্টাতে তার শরীর আরে ভেঙে পড়েছে। এরপরই কন্যার মনের ভয়কে শব্দে পরিণত করলেন শাহজাহান। মনে হচ্ছে জীবন যেন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। জাহানারার চোখে অশ্রু দেখে বলে চললেন, কেঁদো না। প্রত্যেক মানুষের জন্যেই মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট আছে আর মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় যে আমি বোধ হয় আমার সময় পার হয়ে চলে এসেছি। কোন ব্যথা নেই। শুধু জীবনীশক্তি নিঃশেষ। এরপর শক্ত হয়ে গেল শাহজাহানের কণ্ঠস্বর। যাবার আগে পাশবালিশের সাথে ভর দিয়ে আমাকে উঁচু করে ধর, যেন তোমার মায়ের সমাধি দেখতে পাই।
নিজের চোখের অশ্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে জাহানারা পাশপালিশের সাথে হেলান দিয়ে তুলে ধরল পিতার কৃশকায় শরীর পিছনে গুঁজে দিল আরো কয়েকটি তাকিয়া।
ধন্যবাদ। এখন আবার তোমার হাত দাও। কিছু কথা অবশ্যই বলতে হবে।
আরো একবার পিতার হাত নিজের হাতে নিয়ে জাহানারা বুঝতে পারল যে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে লুকোবার কিছু নেই, তাই শুধু মাথা নেড়ে বলল, বলেন। আমি শুনছি।
হয়ত এটা তার কাছে কোন ব্যাপারই না, তবু আওরঙ্গজেবকে বলল যে আমি তাকে ক্ষমা করেছি…সবচেয়ে বড় কথা অনুনয় করবে যেন তার ও তার পুত্রদের মাঝে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যা যা সম্ভব করে সে। হিন্দুস্তানে প্রথম আসার পর থেকে এহেন বিদ্বেষ প্লেগের মত ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের রাজবংশে! আমি চেয়েছিলাম এর সমাপ্তি টানেত…কিন্তু অনুতাপের সাথে বলতে হচ্ছে আমি পারিনি।
আমি তাঁকে জানাবো, আব্বাজান। নরম স্বরে বলে উঠল জাহানারা।