একদা সৈন্য প্রধান হিসেবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলার সময় কত সুদর্শন আর শক্তিশালী দেখাত তার পিতাকে; কিন্তু এখন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সেই পেশীবহুল যোদ্ধার কাঠামো। সময় বড় বেশি কঠিন আচরণ করছে তার সাথে, হয়ত বেশিরভাগ মানুষের সাথেই এমন হয়, কিন্তু তাঁর মত নিষ্ঠুর নয় নিশ্চয়ই আপন রক্ত আর মাংস। শাহজাহানের কারাবাসের সাত বছরের মধ্যে আওরঙ্গজেব একবারও তাকে দেখতে আসেনি অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা চিঠি লিখেনি। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনা যেত রোশনারার মাধ্যমে…বোনের কাছ থেকেই জাহানারা আর তার পিতা অবশেষে জানতে পেরেছিল যে সাম্রাজের পূর্বাংশের কোথাও হারিয়ে গেছে শাহ সুজা। সুলাইমানের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বন্য আরাকানীয় জলদস্যুদের ভূমিতে চলে যায় শাহজাদা আর কখানোই দেখা যায়নি তাকে। একদা একে অন্যের কাছাকাছি থাকা চার ভাইয়ের মাঝে একজনেই শেষপর্যন্ত জীবিত থাকে…আওরঙ্গজেব।
তুলা রাশির জাতক হিসেবে আমার জন্ম হয়েছিল…বলে চললেন শাহজাহান। জাহানারা অনুমান করতে পারলো এরপরে কী বলবেন তিনি। আগেও বহুবার এ কথা শুনেছে সে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান আমার জন্ম মুহূর্তে ঠিক সে রকম ছিল যেমন ছিল তৈমুরের বেলায়। পিতামহ আমার নাম রেখেছিলেন খুররম হাসিখুশি। তিনি বলেছিলেন আমি নাকি ছিলাম রাজকীয়তার টুপির উপরে একটি রেশমী ফিতা আর সূর্যের চেয়েও বেশি জ্যোতিষ্মন। ডিভান থেকে চোখ তুলে কন্যার দিকে তাকালেন শাহজাহান আর চেহারায় এমন এক হাসি ফুটিয়ে তুললেন দেখে মনে হল জরা চলে গিয়ে উঁকি দিয়ে গেল সেই আগেকার মানুষটা। জাহানারা খুশি হয়ে উঠল যে অতীত তাকে এতটা খুশি করে দেখে। বর্তমান তো অন্ধকারে ভরা, যদিও আওরঙ্গজেব তাদের কারাবাসে আরাম আয়েশের উন্নতি ঘটিয়েছে। আবাসস্থল আসবাবপত্র আর যথেষ্ট সংখ্যক ভৃত্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা হারিয়ে এসবে কিই বা লাভ হল? প্রায়ই তাকিয়ে দেখে পিতা চেয়ে আছেন যমুনা তীরে তাজমহলের দিকে। তার একান্ত বাসনা ছিল তাজমহলে গিয়ে নিজের হাতে গড়া উদ্যানে ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু প্রতিবারই আওরঙ্গজেব প্রত্যাখান করেছে। দুর্গ ত্যাগের অনুমতি দিতে।
পিতা, আমাকে সেই গল্পটা আরেকবার বলল–কীভাবে আমার দাদাজানের বাবা আগ্রার রাস্তা দিয়ে ছোট্ট বাচচা হাতির পিঠে চড়িয়ে তোমাকে রাজকীয় মসজিদের বিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন লেখাপড়া শুরু করার উদ্দেশ্যে। এটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে…
এটা মিথ্যে কথা নয়। জাহানারা পিতার শৈশবের কথা শুনতে সত্যিই মজা পায়, কিন্তু তার চেয়েও শাহজাহান বেশি খুশি হয় সেসব দিনের কথা বর্ণনা করতে। এখন পিতার মোলায়েম নিচু স্বর শুনতে গিয়ে নিজের সামনে ঠিক যেন দেখতে পেল সেই ছোট্ট ছেলেটাকে পুরোপুরি চার বছর, চার মাস আর চার দিন বয়সে যেমনটা ছিল ঐতিহ্য–জমকালো সাজে সজ্জিত আকবরের হাতির ঠিক পাশেই, উত্তেজিত হয়ে চারপাশের উল্লসিত আর গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়তে থাকা জনতার দিকে তাকিয়ে…জাহানারার চোখের সামনে ভেসে উঠল, পাগড়ি পরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা হিন্দুর পাশপাশি মুসলমান পণ্ডিতদের দৃশ্য, বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে অপেক্ষা করছে শিশুটিকে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য যেন নিজের শিক্ষা জীবন শুরু করতে পারে শাহজাদা।
কিন্তু শাহজাহান তার গল্পের মাত্র মাঝামাঝি পর্যায়ে আসতেই জাহানারা দেখতে পেল চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি, মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে নড়তে লাগল। গত কয়েকদিন ধরে একটু বেশিই ঘুমাচ্ছেন তিনি। বিরক্ত যাতে না হন তাই নিঃশব্দে নিজের আসন ছেড়ে উঠে গরাদবিহীন জানালার কাছে গেল জাহানারা। প্রথম দিকে নিজের পা জোড়াও মনে হল ভারী, কিন্তু তারপর মনে পড়ল তার নিজেরও বয়স হচ্ছে–এপ্রিল মাসে বয়স হয়ে যাবে বাহান্ন। চুলগুলো, যদিও এখনো বেশ ঘন, বহুবছর ধরে না দেখা কাশ্মিরের তুষারের ন্যায় সাদা হতে শুরু করেছে। যাই হোক, তাকে কেমন দেখাচ্ছে তাতে আর কিই বা যায়। আসে? তাকে দেখার জন্য বেশি কেউ নেই এখন…
জানালা দিয়ে দেখা গেল এক তরুণ উট নিয়ে যমুনা নদীতে নেমে গেছে পানি খাওয়ানোর জন্য, নদীর তীরে ছেলেমেয়েরা ছুটছে, চিৎকার করছে। খুশি হয়ে উঠল জাহানারার মন। তার পরেও বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা করে উঠল ছেলেমেয়েদের উদ্দামতা আর সহজ-সরল আনন্দ দেখে। সেই তুলনায় তার নিজের অস্তিত্ব কতটা আবদ্ধ আর সংকীর্ণ। তারপরেও বলতে হবে তরুণ বয়সে তার জীবনও পূর্ণ ছিল প্রাণ প্রাচুর্য আর জনগণে–মা, ছয় ভাই-বোন, দরবারের অন্তহীন হৈ-চৈ আর কার্যক্রম, তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ, বিভিন্ন পরিচারিকা যারা অবশেষে তার বন্ধু হয়ে গেছে, যেমন সাত্তি আল-নিসা, তাজমহলের মাটিতে এখন নিজের সমাধিতে চির নিদ্রায় শুয়ে আছে… আর অবশ্যই ছিল নিকোলাস ব্যালান্টাইন।
মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্ব সাত্তি আল নিসা দুর্গে আসা নিকোলাসের একটা চিঠি চুরি করে এনেছিল। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে ভ্রমণের তারিখ ছিল আরো এক বছর আগেকার। সহজভাবেই লেখা ছিল যে নিকোলাস দেশে পৌঁছে বাস করছে ভাইয়ের জমিদারিতে কিন্তু হিন্দুস্তানের গরম আর রং এর পাশাপাশি দরবারে তার বন্ধুদেরকেও অনেক হারানোর বেদনা অনুভব করছে।