আমি জানতাম না আওরাঙ্গজেব কী করতে যাচ্ছিল। আস্তে করে বলে উঠল রোশনারা। বিশ্বাস করো যদি আমি জানতাম, চেষ্টা করতাম তাকে রুখতে। কিন্তু দারার জন্যে খুব বেশি দুঃখিত হতে বলো না আমায়। আওরাঙ্গজেব যা করেছে সাম্রাজ্যের জন্যেই করেছে।
আওরঙ্গজেব সবসময়কার মত শুধু নিজের ভালোটাই দেখেছে যেমন তুমি সবসময় তাই করেছ যা তোমার জন্য ভালো। সিল্ক আর মণি-মুক্তা জড়িয়ে কেন এসেছ? যেন আমি ঈর্ষিত হয়ে উঠি। তোমার কি ধারণা ভাইয়ের রক্ত হাতে মেখে তুমি সাম্রাজ্যের প্রধান রমণী হয়ে উঠলেই আমি হিংসা করব তোমাকে? আমি শুধু আশ্চর্য হয়ে ভাবছি যে কেমন ধরনের নারী হলে তুমি কোন দয়া নেই, সহানুভূতি নেই, সচেতনতা নেই ঠিক তোমার আঙ্গুলের হীরেগুলোর মতই–শক্ত।
লজ্জিত হবার মত কিছু করিনি আমি। আমার উপস্থিত যদি তোমার জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠে, চলে যাবো আমি। যদিও তোমার জন্য কয়েকটা সংবাদ নিয়ে এসেছিলাম।
কী সংবাদ?
ভ্রাতুস্পুত্র সুলাইমানকে বন্দি করা হয়েছে।
তৎক্ষণাৎ শাহজাহানের কথা মনে পড়ে গেল জাহানারার। দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাবেন তিনি এ কথা শুনলে। কীভাবে কী হয়েছিল?
দারাকে বন্দি করার পর সুলাইমানের বাহিনী তাকে ছেড়ে যায়। সে নিজেও তখন উত্তরে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ধরা পড়ে যায় আওরঙ্গজেবের এক সেনাপতির হাতে। শিকল দিয়ে বেঁধে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। দর্শনার্থীদের কক্ষে ভাইয়ের সামনে হাজির করা হয়। নারীদের অংশ থেকে সব দেখেছি আমি।
কী শাস্তি ঘোষণা করেছে আওরঙ্গজেব? প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইল জাহানারা।
দয়া দেখিয়েছে। গোয়ালিওয়র দুর্গে পাঠিয়ে দেবার আদেশ দিয়েছে।
মুরাদের মত পোস্ত খেতে?
প্রথমে উত্তর দিল না রোশনারা। এরপর আস্তে করে বলে উঠল, আরো একটা ব্যাপার আছে যা তোমার জানা দরকার। মুরাদ মারা গেছে।
আফিমের প্রভাবে?
না। মুরাদ যে কর্মচারীকে খুন করেছিল, আলী নাকীর ভাইয়ের হাতে। লোকটা আওরঙ্গজেবের কাছে দরখাস্ত দিয়ে জানায় রক্ত অথবা অর্থের মাধ্যমে মৃতের রায় পাবার অধিকার আছে তাদের। ন্যায়বিচার করতে চেয়েছে আওঙ্গজেব। স্বর্ণ দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে লোকটাকে। কিন্তু প্রত্যাখান করে জানের বদলে জান চেয়েছে। আলী নাকীর ভাই।
আর আওরঙ্গজেবও রাজি হয়েছে নিশ্চয়। বলে উঠল জাহানারা। আইনের নামে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেয়াটা কত সহজ। হয়ত আওরঙ্গজেব নিজেই লোকটিকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছে…
আর কোন উপায় ছিল না আওরঙ্গজেবের। লোকটাকে বলেছিল মুরাদকে ক্ষমা করে দিতে। ভাইসুলভ মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু জনসমক্ষে মুরাদের হত্যার আদেশ দিতে হয়েছে। পরবর্তীতের ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকায় লোকটাকে পুরস্কৃতও করেছে আওরঙ্গজেব। কেননা বিক্রি হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে লোকটা। যেমনটা মুরাদ বলেছে, স্বর্ণ দেখে অনেকেই লোভ সামলাতে পারে না।
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল জাহানারা। যেন বহুদূর থেকে ভেসে এলো রোশনারার কণ্ঠস্বর, কিন্তু এখন যেতে হবে আমাকে। আংটি সম্পর্কে খবর পাঠিয়ে দিও। সিল্কের মর্মর-ধ্বনি তুলে চলে গেল তার বোন।
তো মুরদাও মারা গেছে…অন্তত পোস্ত খাবার হাত থেকে তো বেঁচে গেছে। কিন্তু বন্দি সুলাইমানের কী হবে, হয়ত এতদিনে পপি খেতে খেতে চলে গেছে অনেক দূর, ধ্বংসের কাছাকাছি… পরিষ্কার হয়ে এলো জাহানারার ভাবনা। মুরাদের জন্য কিছুই করা যায়নি, কিন্তু ভ্রাতুস্পুত্রকে এখনো সাহায্য করতে পারবে সে। তৈমুরের আংটির বিনিময়ে আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে কথা নিতে হবে সুলাইমানের কোন ক্ষতি হবে না। পিতাকে যতটা জানে সে, নিশ্চিত মানা করবেন না তিনি।
.
২.১৪
আগ্রা দুর্গ, জানুয়ারি ১৬৬৬
আওরঙ্গজেব আমাকে প্রত্যাখান করেছে। আমি ভেবেছিলাম যে মেনে নেবে। লিখেছে যে দক্ষিণে তার অভিযানে অনেক খরচ হয়ে গেছে। তাই বহুমূল্যবান কোন দালান নির্মাণ করতে পারবে না। একজন বৃদ্ধের অতি কল্পনা হিসেবে খারিজ করে দিয়েছে আমার পরিকল্পনা, বলেছে এই ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন না তুলতে…
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল জাহানারা। হৃদয়ের গভীরে জানতে পেরেছিল এটা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই, তারপরেও আশা করেছিল হয়ত মেনে নেবে আওরঙ্গজেব। বহুদিন ধরেই পিতার স্বপ্ন ছিল নিজের সমাধি হিসেবে তাজের মত কালো মার্বেলের ইমারত তৈরি করা যমুনার ওপাড়ে।
দুঃখ পেয়ো না। অন্তত আজকে নিজের জন্মদিনের দিন। নিজের শ্রেষ্ঠ সিল্ক আর মণিমুক্তি দিয়ে বেশ পরিধান করেছে সাবধানী জাহানারা। রান্নাঘরে বিশেষভাবে নির্দেশ পাঠিয়েছে যেন পিতার পছন্দের পদগুলো তৈরি করা হয়, যদিও জানে তিনি বেশি খান না। খাবারের আগ্রহ দিনেকে দিন কমেই যাচ্ছে। যদিও মন ভরল না শাহজাহানের।
আওরঙ্গজেব ঠিক কথাই বলেছে। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার মত এত বয়স পর্যন্ত আর কোন মোগল সম্রাটই বেঁচে থাকেননি। সবচেয়ে দীর্ঘজীবী আকবরও মৃত্যুবরণ করার সময়ে আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট ছিলেন।
চুয়াত্তর বছর বয়স এত বেশি কিছু নয়, পিতা… কিন্তু বলতে গিয়েও জাহানারা খেয়াল করল শাহজাহানকে কতটা দুর্বল আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জন্মদিন যতই এগিয়ে আসছিল ততই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন শাহজাহান। আর অতি ধীরে হলেও গভীরভাবে বোঝা যাচ্ছে বয়সের ছাপ। গত কয়েক সপ্তাহে তো নিজের আরামদায়ক আবাসকক্ষ ছেড়ে বাইরে যাননি বলা চলে, দুর্গের নিচে যমুনার ডান দিকে বাঁকের কাছে তাজমহলের দিকেও তাকাননি।