পিতা, কী করছেন আপনি?
সে আমার সিংহাসন চুরি করেছে; কিন্তু কিছু জিনিস কখনোই তার হবে না…যেমন তৈমুরের আংটি, সেটি আমার সাথে কবরে যাবে–অথবা এটি!
বলার সাথে সাথে বের করে আনলেন যেটি খুঁজছিলেন, গাঢ় সবুজের ভেলভেটের একটা রোল। খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে কার্পেটের উপর উপুড় করে দিলেন, বের হয়ে পড়ল একটা লম্বা, তিন প্রস্থ সুনিপুণ, দীপ্তিমান আর মসৃণ মুক্তার মালা। আমার পিতা এটা আমাকে দিয়েছিলেন যখন আমি আমার প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। কোন এক সময় এটি ছিল পিতামহ আকবরের।
খানিকটা কষ্ট করে দাঁড়িয়ে, ডান হাতে মুক্তার মালাটা ঝুলন্ত অবস্থায় কক্ষের কোণার দিকে হেঁটে গেলেন শাহজাহান। তারপর আবার হাঁটু গেড়ে বসলেন; এবার বড়সড় একটা খোদাই করা কার্পেটের বাটখারার পাশে। নিজের সামনে মুক্তগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, দুহাতে তুলে নিলেন বাটখারা, সজোরে নামিয়ে এনে গুঁড়ো করতে লাগলেন মুক্তাগুলোকে। কয়েকটা চূর্ণ হয়ে গুঁড়ো হয়ে গেল বাকিগুলো গুঁড়ো একত্রে বেঁধে রাখা সিল্কের দড়ি থেকে মুক্ত হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে গেল।
আব্বাজান আব্বাজান, দয়া করে থামুন! কিন্তু জাহানারার দিকে কোন মনোযোগ নেই শাহজাহানের। ভয়ংকর মনে হল এই শীতল অভিব্যক্তি। মনোযোগ দিয়ে একের পর এক মুক্তা গুঁড়ো করে সূক্ষ্ম সাদা ধুলার মেঘ বানিয়ে চললেন শাহজাহান। শেষ করে চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে। কঠিন পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছেন, বুকের ওঠানামার সাথে দেখা গেল চিকচিক অশ্রুবিন্দু।
*
জাহানারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল রোশনারা। তৈমুরের আংটি খুঁজে পেতেই হবে।
ঘণ্টাখানেক আগে বাদ্যের আওয়াজে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল জাহানারা। শশব্যস্ত হয়ে বাইরে এসে দেখে একদা তার থাকা রঙিন হাতিটা বন্ধ রুপালি হাউদাতে করে বোনকে নিয়ে আস্তে আস্তে প্রবেশ করছে হারেমের আঙিনাতে। রোশনারার পরনে জমকালো সোনালি অ্যামব্রয়ডারী করা মেরুন সিল্কের পোশাক। আঙ্গুলে চমকাচ্ছে রত্নপাথর আর গলাতেও একই। হেনায় রাঙানো চুলে জড়ানো হয়েছে রুবি বসানো সোনার সেট। অথচ রং না লাগান হলে চুলগুলো একেবারে জাহানারারই মতন ধূসর। এখন জাহানারা জানে যে এত মাস পরে আগ্রা দুর্গে রোশনারা কেন এসেছে।
ইতিমধ্যেই তোমাকে জানিয়েছি যে আমি জানি না আব্বাজান এটি কী করেছেন। নিজের বাকি সব রত্ন তো দিয়ে দিয়েছেন..যথেষ্ট হয়নি?
না। তৈমুরের আংটিই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় পারিবারিক নিদর্শন। আওরঙ্গজেব জানিয়েছে যে আব্বাজানকে অবশ্যই মনে করাতে হবে।
এ কারণেই মাখদুমী খানকে সরিয়ে তার প্রধান নপুংসককে সুবাদার বানিয়েছে?
হ্যাঁ। আওরঙ্গজেবের ধারণা মাখদুমী খান পিতার প্রতি একটু বেশিই প্রশ্রয়শীল ছিল। পিতার জেদ আর একগুয়েমিতাকেও বাহবা দিয়েছে। কিন্তু ইতিবার খান নিজের দায়িত্ব ঠিকই আরো ভালো করে বুঝবে।
আব্বাজানকে আবাসকক্ষ ছেড়ে বাগানে হাঁটতেও প্রত্যাখানের মাধ্যমে? পিতার পরিচালকদের সংখ্যা আরো কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে? তাঁর সাথে দেখা করার জন্য আমার উপর বাধা আরোপের মাধ্যমে?
হ্যাঁ, সবকিছুই হয়েছে আওরঙ্গজেবের আদেশে।
এটা তো একজন বৃদ্ধ মানুষের প্রতি আক্রোশ আর প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়–তার আপন পিতা।
আংটি না পাওয়া পর্যন্ত সুস্থির হবে না আওরঙ্গজেব। তুমি জানো সে কতটা অবাধ্য হতে পারে।
পিতাও একইভাবে একগুয়ে। আর এর কারণও আছে। তুমি আর আওরঙ্গজেব জানো না যে এই আংটির কী মানে তার কাছে? আওরঙ্গজেব তো বাকি সব জিনিস নিয়েই নিয়েছে–দিল্লিতে লাল দুর্গে যে ময়ূর সিংহাসনে বসে আছে সে এখন, রাজকোষ, মোগলদের সব প্রাসাদ আর জায়গীর সমূহ। এখনো কি তার তৃপ্তি হয়নি? নিজেকে একজন সম্রাট মনে করে সে কিন্তু আচরণ করছে দুর্বলের উপর ডাকাতির মত।
এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না আমি। দুর্গে তোমার সাথে দেখা করিতে এসেছি, কারণ আওরঙ্গজেবই এমনটা বলেছে। তার বিশ্বাস তুমি চাইলেই আব্বাজানকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারো। যদি তুমি এ কাজে সাহায্য কর তাহলে তোমার জন্য আরো আয়েশের ব্যবস্থা করে দেবে সে। আর যদি তুমি প্রত্যাখান কর…
আওরঙ্গজেবকে বলল যে আমি আব্বাজানকে বোঝাতে চেষ্টা করব যেন আংটিটা দিয়ে দেয়, কিন্তু কোন পুরস্কারের আশায় বা হুমকির ভয়ে নয়। পিতার জন্যই এটা করব আমি। যতবার আওরঙ্গজেব আংটি চায়, আব্বাজান এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি চাই তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলি যেন শান্তিতে আর নিরুপদ্রবে কাটাতে পারেন তিনি–তোমারও ঠিক তাই করা উচিত।
কিছুই বলল না রোশনারা।
এতগুলো মাস ধরে তোমার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা। করেছি আমি। বলে চলল জাহানারা, ভেতরে উথলে উঠছে আবেগ। যদি তুমি আমাদেরকে দেখতে নাও আসতে পারো আমাকে অথবা আব্বাজানকে কয়েকটা শব্দ লিখে পাঠাতে কি খুব বেশি কষ্ট হত? তোমার নিশ্চয় জানা ছিল যে দারার মৃত্যুতে কেমন অনুভূতি হবে পিতার? তুমি কি জানতে যে আওরাঙ্গজেব দারার খণ্ডিত মস্তক পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে? কল্পনা করে দেখো থলে থেকে বের করে এটা দেখে কেমন লেগেছে তাঁর…এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে আওরঙ্গজেবকে থামাতে পারোনি তুমি? নাকি এতে কিছুই যায় আসে না তোমার?