তাই নাকি? কিছু না তো!
সত্যি? আমি শুনেছি একটু আগে সন্ধ্যায় নাকি আপনার কাছে সংবাদবাহক এসেছিল? কে সেতুর ক্ষতি করেছে সে ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?
এতটুকুই জানা গেছে যে, কয়েকদিন আগে তিনজন ঘোড়সওয়ারকে চম্বল নদীর আশেপাশে দেখা গেছে কথার টানে মনে হয়েছে দক্ষিণী। আমাদের গতিবিধি, কোথায় সেতু নির্মাণ করতে চাই সে সম্পর্কে খোঁজ খবর করছিল। তাদের খোঁজে লোক পাঠিয়েছি আমি। যদিও জানি যে অনেক আগেই সরে গেছে তারা।
আপনার কী মনে হয় লোকগুলো গোলকুণ্ডা আর বিজাপুর থেকে এসেছিল?
হুম, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
বেশি উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি জানি যে বিলম্ব হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কিন্তু শীঘ্রিই তো আমরা বোরহানপুরে পৌঁছে যাব। অপেক্ষার পালা শেষ হবে আর রণক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলা করতে পারবেন আপনি। আমি জানি এ ব্যাপারে কতটা উৎসুক হয়ে আছেন।
ঠিক বলেছো। আমি এই অভিযান দ্রুত শেষ করতে চাই। বর্তমান সীমান্ত প্রতিরক্ষার চেয়ে বরঞ্চ ভূ-খণ্ড আরো বাড়াতে চাই আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় পূর্বপুরুষ বাবরের ভূ-খণ্ড পূর্ণ দখল করে নেবো…এমনকি সানালি সমরকন্দও দখল করার ভাবনা আসে মনে…।
এ উচ্চাশা পূরণের সময়ও আসবে। কিন্তু প্রতিবারে একটি পদক্ষেপে। আমাদের শত্রুরা যথেষ্ট শক্তিশালী। কোন কিছুকেই চিরস্থায়ী হসেবে ভাববেন না।
*
সামনের খুঁড়ের নিচে শুকনো ঘাসের খোঁচা খাওয়ায় পথ থেকে সরে একপাশে নাড়া খেলো শাহজাহানের ঘোড়া। অপ্রস্তুত অবস্থায় গভীর চিন্তামগ্ন আচ্ছন্ন ম্রাট ঝাঁকুনি খেলেন। গতকাল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে আসিরগাঁ দুর্গে। লাল বালি-পাথর দিয়ে তৈরি এই দুর্গে তিনি এবং মমতাজ পার করেছেন পরবাসের বহু বিদ্রি আর উদ্বিগ্ন মাস। এখানে থাকতেই খবর পেয়েছিলেন যে, পিতা তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করেছেন। মাথার মূল্য ধার্য করে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছেন খুঁজে বের করতে। আসলাম বেগ যদিও বলছিল যে, রাজকীয় পরিবারবর্গ নিয়ে আসিরগাঁ দুর্গে রাত কাটাতে, শাহজাহান বরাবরের মত শিবিরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর আজ রাতে অন্তত বোরহানপুরে পৌঁছাতেই হবে। অভিযানের বাকি পরিকল্পনা করা সহ মমতাজের বিশ্রামেরও সুবন্দোবস্ত হবে।
পত্মীর চিন্তা মাথায় আসতেই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পিছনে ছুটলেন হারেম দলের দিকে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে প্রধান সারির সাথেই ছুটছে এখন তারা, কেননা শত্ৰুভূমি ক্রমশ কাছে চলে আসছে। আট নপুংসকের কাঁধে চড়ে একাকী একটি পালকিতে ভ্রমণ করছেন মমতাজ। পর্দার মাঝে সোনালি কারুকাজ করা ফোকর দিয়ে শাহজাহানকে দেখতে পেয়ে অভিবাদন জানালেন মমতাজ।
আজ আমাদের চলার গতি বেশ ভালো হয়েছে সূর্য ডোবার মাঝেই বোরহানপুরে পৌঁছ যাব। শিবিকা বাহকদের সাথে একইতালে চলতে লাগলেন শাহজাহান।
ভালোই হল। আমিও খেয়াল করেছি সবকিছু বেশ উত্তপ্ত আর শুষ্ক দেখাচ্ছে।
গত বছর অনাবৃষ্টি হয়েছে…সবাই বলছে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। বোরহানপুরে গেলে সব জানা যাবে।
শাহজাহান…
কী?
এখানে ফিরে আসাটা কী অদ্ভুত মনে হচ্ছে? গত কয়েকদিনে কেন যেন আমার বারেবারে মনে পড়ছিল। সবকিছু-ধুলার গন্ধ, ডুবে যাওয়ার আগে লাল সূর্যটাকে দেখে যেন মনে হয় বিস্ফোরণের জন্য তৈরি। এই পাহাড়ের সারির চুম্বক সৌন্দর্য স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। প্রথমবার যখন এখানে এসেছি, একেবারে তরুণ ছিলাম আমরা আর জীবনটাও ছিল সাদাসিধে। ভেবে মন খারাপ হয় যে সময় কত দ্রুত চলে যায়।
আমরা এখনো তরুণ।
আপনি নিশ্চিত?
চলতে চলতে মমতাজের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। অতীত–ভালো-মন্দ মিলিয়েই–ভয়ংকর জায়গা, রোমন্থন না করাটাই অধিক শ্রেয়। গতরাতে, মমতাজ পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন অবস্থায় মোমবাতির আলোয় শাহজাহান আবারো পড়লেন আকবরের জীবনীকার রচয়িতার লেখা :
তারা জানলো যে বোরহানপুরের একটা কুখ্যাতি আছে। অভিশপ্ত আর অন্ধকারচ্ছিন্ন এই জায়গায় কোন মানুষ উন্নতি করতে পারে না। কিন্তু এই কুসংস্কার শুনে হাসলেন তিনি আর মোগলদের জন্য দখল করে নিলেন। জানালেন এ স্থান তিনি বিজয় আর সমৃদ্ধির নিশান উড়াবেন…আর করলেনও তাই।
শাহজাহান সবসময় এই কথাগুলো ভেবে সন্তুষ্টি লাভ করেন যে আকবরের সময় হতেই বোরহানপুর বস্তুত মোগল বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে কাজ করেছে। তরুণ শাহজাদা হিসেবে যে তিনি নিজেও এই জায়গা থেকেই সামরিক বিজয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। আর পরবর্তীতেও তাই করতে চান। তবে এবার যুদ্ধের পরিবর্তে দেখলেন ভিন্ন কিছু অন্ধপ্রায় খসরু অসহায়ের মত শুয়ে আছে বোরহানপুরের পাতাল ঘরে আস্তে করে খুলে গেল দরজা। জীবনের সেই মুহূর্তগুলোতে কী ভাবনা বইছিল তার মনে? ভাবতে কেমন লাগে যে তুমি মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছো আর জানো যে এমনটা ঘটতে যাচ্ছে তোমার আপন ভাইর নির্দেশে? জোর করে এহেন চিন্তা একপাশে সরিয়ে দিলেন শাহজাহান। নিজেকে বোঝালেন এসব দুর্বলতাকে প্রশয় না দিতে। বিশেষত যখন সবকিছু তারই যা তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন অস্বস্তি হল। বোরহানপুরে আসাটা কী ভুল হয়েছে? চাইলে অন্য যে কোন জায়গায় নিজের দরবার বসাতে পারতেন হতে পারে মান্ডুতে…