জাহাপনা, মাথা নত করে কুর্নিশ করল সুলাইমান খান।
সত্যি কথা বল। দায়িত্বে অবহেলা করেছিলে?
কখনোই না, জাহাপনা। এই ঠিকঠাকভাবে আর মজবুত করে তৈরি করা হয়েছিল–আমি আমার জীবনের নামে শপথ করে বলছি। ভালো কাঠ আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দড়ি ব্যবহার করেছি আমরা। গত রাতেই কাজ শেষ করেছিলাম। আর এর শক্তি পরীক্ষা করতে আমি নিজে একটা ভারী গাড়ি চালিয়ে নিয়ে দেখেছি। সেতুটা ভেঙে পড়েছে কারণ কেউ এখানে দুর্নীতি করেছে। দেখুন জাহাপনা…
বুকের কাছে ঝুলতে থাকা পাটের ব্যাগ থেকে দুই মিটার দড়ি বের করে দেখালো সুলাইমান খান। এই ধরনের ছোট ছোট বন্ধনী দিয়ে নদী তীরে সেতু নির্মাণ করেছি আমরা। দেখুন প্রান্তটা কীভাবে কাটা হয়েছে– এগুলো কোন ধরনের ঘষা খেয়ে ক্ষয় হয়নি। এ রকম কাটা দড়ি আমরা আরো পেয়েছি। যদি বড় বড় গিঁটগুলো পরীক্ষা করি, তাহলে নিশ্চিত একটা ফলাফল পাওয়া যাবে।
আমাকে দেখতে দাও, দড়ির প্রান্ত পরীক্ষা করে ফিরিয়ে দিলেন শাহজাহান। ঠিক বলেছো তুমি। এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। গত রাতে প্রহরীরা কিছু দেখতে পেয়েছিল?
না, জাহাপনা।
প্রহরীর সংখ্যা বাড়াও আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেতু মেরামত করে ফেলল। আমি পার্শ্ববর্তী গ্রামে পুরস্কার ঘোষণা করে সৈন্য পাঠাচ্ছি যেন বিশ্বাসঘাতকের খোঁজ পাওয়া যায়।
প্রধান সারির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে যাবার সময় পুরো ঘটনাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। বিদ্রোহী আর আক্রমণকারীরা নতুন ধরনের কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করছে। সেনাবাহিনী যতই দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে, ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তাই তিনি নিজে কঠোর হবার পাশাপাশি তার সৈন্যদের শক্তিও নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রাপথে ঘোড়সওয়ারদের যথেষ্ট অস্ত্রে সুসজ্জিত করতে হবে। কিন্তু শিবির ঠিক কতটা ঝুঁকিতে আছে? রাজকীয় তাঁবুগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। এরপর ভাবনা ঘুরে গেল মমতাজের দিকে। প্রতিদিনের ভ্রমণ শেষে মমতাজ আর কন্যাদেরকে চারপাশে ঘেরা কাঠের বেষ্টনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। দেয়াল বেশ মোটা, লোহা দিয়ে বাঁধা ও কাঠ দিয়ে তৈরি, চারপাশে বেগুনি কাপড় দিয়ে ঘেরা আর চামড়ার বন্ধনি দিয়ে বাঁধা।
কিন্তু বাকি বিশাল তাঁবুর অংশ? বায়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর সভাসদদের তাঁবুগুলোও থাকে রাজকীয় তাবুর পাশপাশি। এরপরে সারিবদ্ধভাবে থাকে অন্যান্য সৈন্য–আর শাহজাহানের সৈন্যের তাঁবু, এছাড়াও আছে সীমাহীন দড়ির ঘেরাও, যার মাঝে রাখা হয় পশুর পাল। কিন্তু এর পরের পৃথিবী তো একেবারে বিশৃঙ্খল। আরো হাজারো তাঁবুবাসী যেগুলো সবসময় থাকে একটা সৈন্যবাহিনীর পিছনে। ব্যববসায়ী আর ঘোড়ার বণিক, নাচুনে দল আর শিল্পীরা, দড়িবাজ, জাদুকর, দেহপসারিনী–সকলেই আসে জীবিকার খোঁজে। এই দঙ্গলে শত্রুর আগমন ঠেকানো দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে। তাঁবুর প্রহরায় থাকা সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চৌকি বসিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তির তল্লাশির ব্যবস্থাও করতে হবে।
*
প্রথম হাউইটা আকাশে উড়ে যেতেই সোনালি তারার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ। চকচকে একটা পর্দা মতন তৈরি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল রুপালি বৃষ্টির মত। চাইনিজ বাজি নির্মাতারা হতাশ করেনি, ভাবলেন শাহজাহান। এই ধরনের একটি প্রদর্শনী কেবল একজন সম্রাজ্ঞীর জন্মদিনেই মানায়। হারেমের তাঁবুতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মমতাজ বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন বহু উপরে বিশাল ময়ূয়ের স্যাপায়ার আর এমেরান্ডের লেজ দেখে। পত্নীর খুশি দেখে সেতু নিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ভাবনা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল। এছাড়াও সংবাদ পেয়েছেন যে আগামীকালই সেতু মেরামতের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে আর নিজের যাত্রা আবারো শুরু করতে পারবেন তিনি পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা বিলম্ব শেষে।
তাঁবুর আগুন থেকে ভেসে এলো মুখরোচক সুভাস। অন্ধকার চিরে দিল কমলা আগুনের রশ্মি। শাহজাহান আদেশ দিয়েছেন যেন হাজারে হাজারে ভেড়া ক্রয় করে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়; যেন তারা ভোজ উদ্যাপন করতে পারে। অন্যদিকে ভোরের কুয়াশা কাটার আগে থেকেই কাজে নেমে পড়েছে রাজকীয় বঁধুনী। পাখির মাংস জোগাড় করা, মসলা পেষা, বাছাই করা, অ্যাপ্রিকট, চেরী আর কিশমিশ, সাথে আছে আমন্ড আর ওয়ালনাট মিশিয়ে সুগন্ধযুক্ত মাখন, ঘি আর পেতার সস্ তৈরি করা। বয়স্ক আর খোঁড়া রাজকীয় গৃহভৃত্য আসলাম বেগ লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে ঘুরে তদারক করছে সমস্ত প্রস্তুতির। ভর্ৎসনা করছে রাধুনীদের। এছাড়া নির্ভেজাল সোনা আর রুপার থালা বের করে রাজকীয় টেবিলে পরিবেশনের পূর্বে প্রতিটি পদ পরীক্ষা করে ঢেকে দেয়ার দায়িত্বও তার।
শাহজাহান আশা করছেন খাদ্যের প্রতি সুবিচার করবেন মমতাজ। যদিও মমতাজ মানতে চাননা, কিন্তু তিনি টের পেয়েছেন যে মমতাজের খাদ্যশৃহা–যদিও কখনোই খুব বেশি ছিল না–একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। চেহারা প্রায়ই যন্ত্রণাকাতর দেখায়, চোখের নিচেও ক্লান্তির ছায়া। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই পাহাড়ে চড়বেন তারা, ঠাণ্ডা নির্মল বাতাসে হয়ত অবস্থার উন্নতি হবে।
সর্বশেষ আতশবাজিটা স্বর্গের উদ্দেশে রওনা দেবার পর শাহজাহান শুনতে পেলেন মমতাজের মৃদু ভর্ৎসনা, কী ভাবছেন আপনি? বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে?