নেংটিপরা লম্বা, বলিষ্ঠ গড়নের আরেকজন সতনামি লাফ দিয়ে মোগল বাহিনীর একটি কালো ঘোড়ার ঘাড়ের উপর চড়ে বসে কেবল গায়ের জোরে আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে টেনে আরোহীসহ ঘোড়াটিকে মাটিতে টেনে নামাল। তারপর হতবুদ্ধি হয়ে পড়া মোগল সৈন্যটির হাত থেকে তরোয়াল কেড়ে নিয়ে তার গায়ে ঢুকিয়ে দিল। তার দেখাদেখি অন্যান্য সতনামিরাও তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করলো। সবাই সফল হল না, কেউ ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল আবার কেউ ঘোড়র পায়ে পিষ্ট হল। তবে প্রায় বিশজন মোগল সেনা মাটিতে পড়ে গেল। কেউ কেউ নদীর তীরে কাদার উপর হাতপা ছড়িয়ে পড়ে রইল আবার কেউ কেউ চারপাশ থেকে ছুরি আর বর্শা নিয়ে একনাগাড়ে কুপিয়ে চলা সতনামিদের প্রতিহত করে যেতে লাগলো। যাইহোক শীঘ্রই নদীর তীরে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা সতনামিদের লাশের সংখ্যা দেখে বুঝা গেল লড়াই মোগলদের সপক্ষেই যাচ্ছে। তারপরও শরীরের কয়েক জায়গায় আহত হয়ে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত বাকি সতনামিরা মাটি কামড়ে ধরে লড়াই করে চললো।
আওরঙ্গজেবের যুদ্ধহস্তীটি সতনামি শিবিরের কেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারির কাছাকাছি পৌঁছতেই বড় একটি তাঁবু থেকে দশবারোজন লোক হৈ হৈ করে ছুটে বেরিয়ে এল। এদের কয়েকজনের হাতে গাদা বন্দুক ছিল আর তা ওরা আওরঙ্গজেবের দিকে নিশানা করার চেষ্টা করতে লাগলো। আওরঙ্গজেবের দুজন দেহরক্ষী ওদেরকে আক্রমণ করলো, তবে তার আগেই একজন সতনামি গুলি ছুঁড়লো। মাথায় গুলির আঘাত লেগে একজন দেহরক্ষী তার ঘোড়ার ঘাড়ের উপর লুটিয়ে পড়লো। আতংকিত ঘোড়াটি ছুটে নদীতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আর আরোহীর দেহটি মুখ নিচু করে কাদাভরা পানিতে পড়ে গেল। সবুজ পাগড়িপরা দীর্ঘদেহের অপর দেহরক্ষীটি তার বীরত্ব দেখিয়ে চললো। সে তিনজন সতনামি বন্দুকবাজকে ঘায়েল করলো। লোকগুলো তাদের লম্বা নলের বন্দুক সোজা করে ধরার আগেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে তরোয়াল দিয়ে অর্ধনগ্ন সতনামিদের হাড্ডিসার শরীরে কুপিয়ে চললো।
একজন সতনামি গাদা বন্দুক ছুঁড়তেই ক্ষিপ্রগামী ঘোড়াটি ঘুরিয়ে সে ধাক্কা দিয়ে বন্দুকের নলটি সরিয়ে লোকটির কামানো মাথায় তরোয়ালের কোপ মেরে মাথাটা কেটে দুভাগ করে দিল। দ্বিতীয় সতনামিটি দ্রুত তার প্রাচীন বন্দুকটি ঘুরিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে দেহরক্ষীর ঘোড়াটির গলায় আঘাত করলো। যন্ত্রণায় চিহিহি করে ঘোড়াটি পেছনের পা উঁচু করে আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলে দিল। সতনামিটির পায়ের কাছে মোগল দেহরক্ষীটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, তোয়াল হাত থেকে ছুটে গেল। সতনামিটি আবার বন্দুকের কুঁদো উঁচু করে দেহরক্ষীটির তলপেটে আঘাত করলো। শরীর ভাঁজ করে মোগল সেনাটি উঠে বসতেই সমিটি তার পাগড়িপরা মাথা লক্ষ করে বন্দুকের কুদো চালালো, তবে মোগলসেনাটি ঠিক সময়ে শরীর মুচড়ে সরে গেল। তারপর সে কোমর থেকে ছুরি বের করে সতনামিটির নগ্ন ঊরুতে বাটপর্যন্ত ছুরির ফলাটি ঢুকিয়ে দিল। লোকটি সেদিকে মোটেই খেয়াল না করে আবার তার বন্দুকের কুঁদো উঠিয়ে আঘাত করলো। তবে দেহরক্ষী বন্দুকের কুঁদোটা ধরে ফেলে এক টানে সতনামিটির হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপর অতিকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বন্দুকের কুঁদোটা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কয়েকবার সতনামিটির মুখে আঘাত করে তার নাকমুখ থেতলে দিল।
ইতোমধ্যে অন্য সতনামিটি আওরঙ্গজেবের দিকে গুলি ছুঁড়লো। গুলি লেগে হাওদার কাঠের ছাদের একটি অংশ ভেঙ্গে গেল। আওরঙ্গজেব চিৎকার করে মাহুতকে বললেন, ‘ঐ লোকটা আবার গুলি ভরার আগেই তার উপর হাতি চালিয়ে দাও। সাথে সাথে মাহুত তার নির্দেশ মেনে হাতি এগিয়ে নিল। তবে হাতিটি সতনামি বন্দুকধারীর কাছে পৌঁছাবার আগেই, যে দেহরক্ষীটি লড়াই করছিল, সে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। লোকটির পায়ের গোড়ালি ধরে তাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে তার হাত থেকে গাদা বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল। তারপর ঘুসি মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেললো।
যে তাঁবুর আড়ালে বন্দুকধারীরা লুকিয়ে ছিল, এখন সেই তাঁবুর কাপড় এক টানে সরিয়ে ছোটখাট কঠোর চেহারার লম্বা পাকাচুলের একটি নারী মূর্তি দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বের হয়ে এল। সে বার বার উচ্চারণ করে চললো, ‘আমি জাদুকরী! আমি জাদুকরী!’ জাদুকরীটি ডানে বামে না তাকিয়ে মাথা উঁচু করে সোজা আওরঙ্গজেবের হাতিটির দিকে হেঁটে চললো। কয়েকজন দেহরক্ষী ভয়ে পিছিয়ে এল। কেউ তাকে থামাতে এগিয়ে এল না। আওরঙ্গজেবের হাতির সামনে এসে থেমে সে সম্রাটের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, আপনি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। আপনার অস্ত্র দিয়ে আমাকে আর আমার অনুসারীদের উপর আঘাত করলে, তা আবার সেরে যাবে আর আমরা আবার জেগে উঠবো। তবে আমি যেখানে আঘাত করবো, তা কখনও সারবে না। আমি মনে আঘাত করবো। আমি অভিশাপ দিচ্ছি আপনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন, তবে কখনও আপনার পরিবারে কিংবা রাজত্বে শান্তি খুঁজে পাবেন না।
আওরঙ্গজেব কোনো উত্তর না দিয়ে পেছনে বসা আর্দালিকে বন্দুকটা দিতে বললেন। হাতে তুলে নিয়ে জাদুকরীর দেহের দিকে লক্ষ্যস্থির করলেন। সে মোটেই ঘাবড়াল না, বরং আওরঙ্গজেবের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার তার সেই সম্মোহনকর মন্ত্র আউড়াতে শুরু করলো। একটি মুহূর্ত আওরঙ্গজেব থমকালেন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে গুলি ছুড়লেন। জাদুকরীর হাড়জিরজিরে বুক থেকে ফিনকি দিয়ে লাল টকটকে রক্ত বের হয়ে তার পুরোনো পাতলা মসলিনের পোশাক রাঙিয়ে দিল, কিন্তু তার চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না এমনকি চোখের পাতাও কাঁপলো না। সে স্থির দৃষ্টিতে আওরঙ্গজেবের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থেকে গল গল করে রক্ত বের হয়ে চিবুক ভিজিয়ে দিলেও সে তখনও সেই মন্ত্র আউড়ে চললো। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙ্গে সামনের দিকে মুখ করে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে কাদার উপর মুখ থুবড়ে পড়তেই মন্ত্র থেমে গেল।