তার অধীনে প্রায় ১৫০, ০০০ সৈন্য এবং প্রায় সমসংখ্যক শিবির শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও অবরোধ খুব ধীর গতিতে চলছিল। ইতোমধ্যে কয়েক মাস পার হয়ে গেছে এবং গুজব রটেছিল যা পরবর্তীতে আমি সত্য জেনেছিলাম যে, সম্রাট সামরিক বিজয় সম্পর্কে হতাশ হয়ে দুর্গের সামরিক নেতাদেরকে ঘুষ দিয়ে দুর্গ তার হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা করছিলেন। বিশাল মোগল শিবির প্রায় ত্রিশ মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। জানতে পারলাম ওদের কাছে ৫০,০০০ উট, ৩০,০০০ হাতি আর সেই সাথে ২৫০টি ভ্রাম্যমাণ বাজারও রয়েছে। সে যাইহোক জায়গাটির কোনো কোনো স্থানে হাঁটু পর্যন্ত কাদা আর বড় বড় সবুজ শ্যাওলাভরা পানির ডোবা ছড়িয়েছিল। এসব জায়গায় প্রচুর মশা ভন ভন করতো। সম্রাটের অনেক সভাসদ আর সেনাপতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন পর আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লাম আর চাল ধোয়া পানির মতো আমার পাতলা পায়খানা শুরু হল। সম্রাটের একজন আমিরের আমার মিশন সম্পর্কে যথেষ্ট সমবেদনা ছিল, তিনি আমাকে আফিম মেশানো টক দই খেতে দিলেন, যাকে ওরা লাসসি বলেন। এটা খাওয়ার পর কিছুটা আরাম পেলাম, তবে আবার ভীষণভাবে এবং ঘন ঘন যন্ত্রণাটি শুরু হল। আমার বেঁচে থাকার ব্যাপারে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম। তবে আমার পীড়ার বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়ে মহামান্যকে বিরক্ত করতে চাই না।
কিছুটা আরোগ্য লাভ করার পর শরীর একটু সুস্থ হতেই আমি সম্রাটের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে আর্জি পেশ করা শুরু করলাম। বেশ কয়েকবার কয়েকজন দুর্নীতিপরায়ণ অমাত্য অর্থের বিনিময়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার কথা বলে ব্যর্থ হল। তাদের এই আচরণের একটা কারণ আমি বলতে পারি যে, বেশিরভাগ মোগল সেনার মতো এরাও দীর্ঘকাল–কয়েক মাস কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক বছর যাবত তাদের সেবার বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে কোনো বেতন কিংবা পুরস্কার পায় নি। বিরাট এলাকাজুড়ে শিবির স্থাপন করায় আশেপাশের এলাকার লোকদেরও যথেষ্ট ভোগান্তি হয় যার কারণে ওরা মোগলদের শত্রুকে সমর্থন করতে উৎসাহিত হয়।
সম্রাটের বয়স প্রায় তিরাশি হওয়ায় তার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা বহুল প্রচলিত ছিল। শাহজাদা মুয়াজ্জমের সমর্থকরা আমার সহযোগিতা কামনা করে জানাল তিনি ক্ষমতায় এলে আমাদেরকে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দেয়া হবে। আমার এখানে আসার পাঁচবছর আগে সম্রাট তাকে গোয়ালিয়র কারাগার থেকে মুক্তি দেন। গোলকুন্ডি শত্রুদের সাথে যোগাযোগ করার অপরাধে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমিও যথেষ্ট ভদ্রভাবে তাদেরকে ইংরজেদের বদান্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তবে যখন শাহজাদার সাথে দেখা হল তখন দেখলাম তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং তার মনোবল কিছুটা ভেঙ্গে গেছে মনে হল। তবে তার বাবার রাগ এড়াতে এটাও এক ধরনের ভান হতে পারে, তবে এতে আমার সন্দেহ হল। সম্রাট লৌহকঠিন হস্তে তাঁর ছেলে এমনকি মেয়েদেরকেও শাসন করেন। এমনকি তিনি তার একান্ত প্রিয় পুত্র কমবখসকেও অসদাচরণের জন্য একবার সংক্ষিপ্ত কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অসদাচরণ ছিল মাতাল হওয়া। লোকে বলাবলি করে তার মা, সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী উদিপুরী মহল তার হাঁটুর উপর মাথা রেখে ছেলের মুক্তির জন্য কাকুতিমিনতি করে বলেছিলেন যে, তার নিজের কারণেই তার ছেলে এটা করেছে, দোষ তারই। সে কেবল তার মায়ের বদভ্যাস অনুসরণ করছিল।
আমি প্রথম সম্রাটকে দেখতে পেলাম যখন তিনি একটি শিবিরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, অবরোধ পরিদর্শনের জন্য তাকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার পুরো অবয়ব ছিল সাদা ধবধবে, পোশাকে, পাগড়ি, চুলে এমনকি দাড়িও সাদা ছিল। তিনি ছিলেন একজন মর্যাদাজ্ঞাপক ব্যক্তিত্ব, কারও দিকে তাকাচ্ছিলেন না, সারাক্ষণ পবিত্র কুরআনের উপর চোখ রেখে পড়ে যাচ্ছিলেন, একবারও এদিক ওদিক তাকান নি। অনেকেই তার ধার্মিকতার প্রশংসা করে, তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তিনি অনেকের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
২৮ এপ্রিল তার সাথে আমি দেখা করার অনুমতি পাই। তিনি অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে আপনার উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানান আর আপনার দীর্ঘ শাসন কামনা করেন। এধরনের ভূমিকার পর তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে আমাকে জানান তাঁর কাছ থেকে আমি সেরকম বন্ধুত্ব কিংবা স্বাধীনতা আশা করতে পারি না যা, তাঁর পিতামহ সম্রাট জাহাঙ্গীর আমার পূর্বসূরি স্যর টমাস রো’এর সাথে করেছিলেন। আরো বললেন তিনি বিদেশি মদ কিংবা গভীর রাতে ভিনদেশী দর্শন নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারেও আগ্রহী নন।
তবে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তিনি আমাদের অনুরোধের প্রতি বিশেষ সুনজর দেবেন, যদি আমরা ভারত মহাসাগর থেকে জলদস্যুদের উচ্ছেদ করি–যার মধ্যে অনেকেই ইংল্যান্ড আর আমাদের উপনিবেশ থেকে আগত। বিশেষত বোম্বে (মুম্বাই) বন্দরের অদূরে হাজিবাহী মোগল জাহাজ গনজ-এ সাওয়াই থেকে হেনরি এভারি তাঁর হিসেবে প্রায় ২০০,০০০ পাউন্ডের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন। সম্প্রতি জলদস্যুরা কায়েদাহ মার্চেন্ট জাহাজটি দখল করার বিষয়েও অভিযোগ করলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম যে, তাঁর মতোও আমরাও সাগর থেকে জলদস্যুদের উৎখাত করতে বিশেষ আগ্রহী। আর জানালাম অনেক প্রচেষ্টার পরও এভারিকে ধরতে না পারলেও উইলিয়াম কিডকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যে, কায়েদাহ মাচেন্ট জাহাজের উপর আক্রমণ করেছিল। আমাদের নৌ-বাহিনীর শক্তি আর উভয়ের স্বার্থে এটি ব্যবহার ব্যাপারে তিনি খুব একটা আস্থা স্থাপন করতে পারলেন না। তারপর আমাকে বিদায় জানিয়ে আমার অনুরোধের বিষয় নিয়ে তাঁর রাজকর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করতে বললেন।