সাফোক আর লন্ডনে চিত্রায়িত হলো ওই সিরিয। চার্লি ক্রিড-মাইল্স্ নামের দুর্দান্ত এক অভিনেতা অভিনয় করলেন আমার সেই গোয়েন্দা-চরিত্রে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর সঙ্গে হোথর্নের শারীরিক গঠনের খুব মিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, হোথর্ন ততদিনে ঢুকে পড়েছে আমার অবচেতন মনে… আমার চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কাজেই ওর চরিত্রের খারাপ দিকগুলো হয়তো অবচেতনভাবেই আমি ঢুকিয়ে দিতে শুরু করেছি আমার গোয়েন্দা-চরিত্রের ভিতরে। তার নামও আমি রেখেছিলাম হোথর্নের নামের সঙ্গে মিলিয়ে- ড্যানিয়েলের সঙ্গে মিল রেখে মার্ক, আর হোথর্নের সঙ্গে মিল রেখে ওয়েনবর্ন। চার নম্বর পর্বের শেষে যখন মার্ক ওয়েনবর্নকে মেরে ফেললাম আমি, স্বীকার করছি, তখন একটুখানি হলেও হাসি ফুটে উঠেছিল আমার ঠোঁটের কোনায়।
ফিরে আসি বর্তমানে। হোথর্ন কেন হঠাৎ দেখা করতে চাইছে আমার সঙ্গে, ভাবছি। আমার যে-জগৎ, তাতে ওর কোনো ভূমিকা নেই। এবং ওকে এই মুহূর্তে কোনো কাজে দরকারও নেই আমার। আবার এই কথাও সত্যি, এখনও লাঞ্চ সারিনি, আর ওদিকে লন্ডনের সেরা যত কেক আছে সব পাওয়া যায় জে অ্যান্ড এ-তে।
শেষপর্যন্ত ঠিক সময়েই গেলাম জায়গামতো।
রেস্টুরেন্টের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে হোথর্ন, একটা টেবিলের ধারে কফি আর সিগারেট নিয়ে বসেছে। শেষবার যখন দেখেছিলাম ওকে, তখন ওর পরনে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে: সেই একই স্যুট, একই টাই, একই রেইনকোট। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তুলে তাকাল, মাথা ঝাঁকাল।
‘শুটিং কেমন হলো আপনাদের?’ জানতে চাইল।
‘কাস্ট এবং ক্রু-স্ক্রীনিঙের সময় আসা উচিত ছিল আপনার,’ বললাম আমি। ‘লন্ডনের একটা হোটেল ভাড়া নিয়ে সেখানে প্রথম দুটো পৰ্ব দেখিয়েছিলাম আমরা। আপনাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে।’
‘ব্যস্ত ছিলাম আমি তখন,’ বলল সে।
একজন ওয়েইট্রেস এগিয়ে এল আমাদের দিকে। চা আর একটুকরো ভিক্টোরিয়া স্পঞ্জের অর্ডার দিলাম আমি। তারপর তাকালাম হোথর্নের দিকে। ‘কেমন আছেন?’
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘আছি একরকম… কোনো অভিযোগ নেই আর কী। গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন মনে হয়?’
ঘটনাক্রমে সেদিন সকালেই ফিরেছি আমি সাফোক থেকে। আমার স্ত্রীকে নিয়ে দুটো দিন কাটিয়েছি সেখানে।
‘হ্যাঁ,’ ক্লান্ত গলায় বললাম।
‘নতুন একটা কুকুরছানাও পেয়ে গেছেন বোধহয়!’
কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালাম হোথর্নের দিকে। এটা ওর আরেকটা ট্রেডমার্ক। নিজে থেকে যদি কিছু না-ও বলি আমি ওকে, এটা-সেটা বিভিন্ন কথা বলে দেয় সে আমার ব্যাপারে। কী করে করতে পারে কাজটা, সে-ই ভালো জানে। লন্ডনের বাইরে গিয়েছিলাম আমি, সেটা এখন-পর্যন্ত জানাইনি কাউকে। এমনকী টুইটারেও কিছু লিখিনি ওই ব্যাপারে। আর ওই কুকুরছানার কথা যদি বলি… ওটা আমাদের এক প্রতিবেশীর। তাঁরা একটা কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন কিছু দিন, তখন ওটার দেখভাল করতে হয়েছে আমাদেরকে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান,’ আমার প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গেল হোথর্ন। ‘যা-হোক, কাজের কথায় আসি। একটা ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
‘যেমন?’
‘আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারবেন?’
যতবার দেখা হয়েছে হোথর্নের সঙ্গে, কিছু-না-কিছু বলে আমাকে চমকে দিয়েছে সে… আজ আরও একবার চমকে উঠলাম।
‘মানে?’
‘আমি চাই আমাকে নিয়ে একটা বই লিখুন আপনি।’
‘সেটা কেন করতে যাবো আমি?’
‘টাকার জন্য।’
‘কে দেবে আমাকে সে-টাকা? আপনি?’
‘না। বইটা লিখে যা কামাই হবে, সেটা আধাআধি ভাগ করে নেবো আমরা দু’জন।’
দু’জন লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে, পাশের টেবিলটাতে বসে পড়ল। নার্ভাস লাগছে আমার– মুখের উপর মানা করে দিতে ইচ্ছা করছে হোথর্নকে, কিন্তু করতে পারছি না কাজটা।
‘বুঝলাম না আসলে,’ বললাম আমি। ‘ঠিক কী ধরনের বইয়ের কথা বলছেন আপনি?’
ঘোলাটে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। ‘বুঝিয়ে বলি তা হলে। আপনি জানেন, টেলিভিশনের জন্য এখানে-সেখানে টুকটাক কাজ করি আমি। হয়তো এই কথাও শুনেছেন, পুলিশফোর্স থেকে লাথি মেরে বের করে দেয়া হয়েছে আমাকে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, এখন টুকটাক কনসালটেন্সিও করি… এবং সেটা পুলিশের জন্য। তবে ব্যাপারটা আনঅফিশিয়াল। অস্বাভাবিক কোনো কিছু যখন ঘটে, তখন ডাক পড়ে আমার, কাজে লাগানো হয় আমাকে… ওরা আসলে কাজে লাগায় আমার কর্মঅভিজ্ঞতাকে। কখনও কখনও কোনো কোনো কেস একেবারে পানির-মতো সহজ হয় মেট্রোপলিটন পুলিশের জন্য, কখনও আবার তা হয় না। যখনই কঠিন কোনো সমস্যায় পড়ে যায় তারা, দ্বারস্থ হয় আমার।’
‘আসলেই?’ কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
‘হ্যাঁ। আধুনিক পুলিশ এভাবেই কাজ করে আজকাল। আসলে বিভিন্ন কারণে অভিজ্ঞ এত লোককে বাদ দেয়া হয়েছে ফোর্স থেকে যে, জটিল কোনো সমস্যার সমাধান করার জন্য এখন আর কেউই নেই বলা যায়। গ্রুপ ফোর অথবা সার্কোর নাম শুনেছেন? দুটোই বেসরকারি তদন্ত সংস্থা… সাহায্য করে পুলিশকে। এমন সব উপায়ে এমন সব তথ্য জোগাড় করে তারা, যা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। শুধু তা-ই না। ল্যাম্বেথে বড় একটা ল্যাবরেটরি আছে আমাদের, প্রয়োজন হলে সেটাও ব্যবহার করি। কখনও কখনও রক্তের-নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হয় সেখান থেকে, অন্য বিভিন্ন ফরেনযিক সাপোর্টও পাই। কাজেই এখন আমাকে একটা এক্সটার্নাল রিসোর্স বলা যায়।’