ওর আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি। যতবার আমার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে, কফি (কালো, চিনিসহ) খেয়েছে, সিগারেট টেনেছে, কিন্তু কোনো খাবার খায়নি। এমনকী বিস্কিটও না। এবং সব সময় একই কাপড় পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সুতরাং, ওই যে বলেছিলাম, সে নিজেই যেন পরিণত হয়েছে নিজের বাজে একটা ফটোগ্রাফে– সেই একই ফটো বার বার দেখতে হয়েছে আমাকে। সেই ফটোর যেমন কোনো পরিবর্তন নেই, ওরও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই।
মজার কথা হলো, আমার ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান হোথর্নের। আমার প্রায় সব কিছুই জানে সে। ওর সঙ্গে যেদিন প্রথমবার দেখা হলো, তার আগের রাতে গলা ভেজানোর জন্য বাসার বাইরে গিয়েছিলাম। আমার সহকারী অসুস্থ ছিল, সপ্তাহান্তের দুটো দিন বুঁদ হয়ে ছিলাম আমি লেখালেখির কাজে। আশ্চর্য, কথাগুলো আমাকে গড়গড় করে বলে দিল হোথর্ন! অফিসের কারও সঙ্গে আমার ব্যাপারে কথা বলছিল কি না সে, ভাবলাম। কিন্তু বললেই বা কী… যে-কথা বলে আমাকে তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছে সে, সেটা তো জানার কথা না অফিসের কারও!
যা-হোক, আমার সেই চিত্রনাট্যের দ্বিতীয় খসড়াটা যখন দেখালাম ওকে, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতিটা ঘটল তখনই। ঘটনাটা বলার আগে আরেকটা কথা বলে রাখি। সে-সময় কোনো একটা পর্বের শুটিং শুরু হওয়ার আগে ওই পর্বের চিত্রনাট্য লেখা এবং সম্পাদনার কাজটা কমপক্ষে বারোবার করতে হতো আমাকে কারণ কখনও এটা-সেটা বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তন করতে বলতেন প্রযোজক নিজেই, কখনও আবার সেটা করতে বলত আমাদের ব্রডকাস্টার। কখনও বলত আমার এজেন্ট, আবার কখনও পরিচালক বা কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী। আসল কথা হচ্ছে, সবাই চাইত, কোনো খুঁত বা সমস্যা যাতে না-থাকে সেই চিত্রনাট্যে।
কিন্তু হোথর্ন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। এই ব্যাপারে ওর আচরণ ছিল ইট- দিয়ে-বানানো নিরেট কোনো দেয়ালের মতো। এই ব্যাপারে একবার যদি সে মনে করত কোথাও কোনো ভুল হয়েছে, তা হলে ওকে বোঝানোটা ছিল এককথায় অসম্ভব।
আরও একটা উদাহরণ দেয়া যাক। চিত্রনাট্যের একজায়গায় আমার গোয়েন্দা দেখা করতে গেছে ওর সিনিয়র অফিসার… অর্থাৎ পুলিশের একজন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্টের সঙ্গে। কোথায় দেখা করতে গেছে তা-ও বলি… প্রত্যন্ত এক ফার্মহাউসের ভিতরে আবিষ্কৃত হয়েছে এক প্রাণীঅধিকার-কর্মীর লাশ, সেখানে। ওকে বসতে বলেছেন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট, কিন্তু জবাবে সে বলছে, ‘আপনি যদি কিছু মনে না-করেন, তা হলে দাঁড়িয়েই থাকি আমি, স্যর।’
আসলে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছুটা হলেও ঝামেলা আছে আমার গোয়েন্দা চরিত্রের। কিন্তু হোথর্ন সেটা মানতে নারাজ।
ও-রকম কখনও হয় না,’ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল সে।
কোনো একটা রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে ছিলাম আমরা সেদিন… ঠিক কোথায় বসে ছিলাম তা এখন আর মনে নেই; আমাদের দু’জনের মাঝখানে একটা টেবিলের উপর রাখা ছিল চিত্রনাট্যের পাণ্ডুলিপিটা। বরাবরের মতো হোথর্নের পরনে স্যুট আর টাই। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা খাচ্ছে সে, খালি প্যাকেটটা ব্যবহার করছে অ্যাশট্রে হিসেবে।
‘কেন হয় না?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘কারণ আপনার সিনিয়র কোনো কর্মকর্তা যদি বসতে বলেন আপনাকে, তা হলে আপনাকে বসতেই হবে।’
‘আমার গোয়েন্দা-চরিত্র যে বসেনি, সেটা তো কোথাও বলিনি আমি।’
‘না, তা বলেননি, তবে সে ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক করেছে। (ছাপার অযোগ্য একটা গালি দিয়ে বসল হোথর্ন) আপনার গোয়েন্দাচরিত্র এ-রকম বোকাটে কেন, বুঝলাম না।’
কথায় কথায় গালি দেয়ার বদভ্যাসও আছে ওর।
‘আসলে ঘটনার সঙ্গে… বলা ভালো দৃশ্যটার সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি আমি ওই সংলাপের মাধ্যমে,’ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। ‘তার চেয়েও বড় কথা, দু’জন পুলিশ অফিসারের পারস্পরিক সম্পর্কটা ফুটে উঠেছে ওই সংলাপের মধ্য দিয়ে।’
‘কিন্তু ভুল করেছেন আপনি, টনি, মিথ্যা একটা দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। আনাড়ির মতো হয়ে গেছে কাজটা।’
‘মিথ্যা দৃশ্য? বাস্তব জীবনে যেমনটা ঘটে, টেলিভিশনের কোনো সিরিযে কি ঠিক তা-ই দেখানো হয়? টিভিতে পুলিশ, ডাক্তার, নার্স বা অপরাধীদের দেখে যা শিখি আমরা, তাদেরকে নিয়ে যখন কিছু লিখি, সেই শিক্ষাটাই কিন্তু তখন ঘুরপাক খেতে থাকে আমাদের মস্তিষ্কে… আমরা সে-শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। বাস্তবের পুলিশ, ডাক্তার, নার্স বা অপরাধী কেমন হয়, সেটা কিন্তু ভাবি না আমরা বেশিরভাগ সময়ই।’
কিন্তু ব্যাপারটা হোথর্নকে বোঝানো গেল না কিছুতেই। আমার সঙ্গে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল সে… বিশেষ করে যেসব দৃশ্যে পুলিশি কর্মকাণ্ড আছে, সেসব নিয়ে। কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না ওকে, আমি যা লিখেছি তা একটা কল্পকাহিনি মাত্র, কোনো ডকুমেন্টারি ফিল্ম না।
কাজেই পাঁচ পর্বের ওই ধারাবাহিকের সবগুলো চিত্রনাট্য যখন লেখা হলো শেষপর্যন্ত, যখন সেগুলো তুলে দিতে পারলাম যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে, এবং যখন আর যোগাযোগ করার দরকার থাকল না হোথর্নের সঙ্গে, তখন আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এটা-সেটা জানার যদি দরকার হতো কখনও, প্রোডাকশন অফিসকে বলে দিতাম, ওরাই তখন ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করত হোথর্নের সঙ্গে।