ইলেভেন্থ আওয়ার ফিল্মসের প্রোডাকশন অফিসে প্রথম দেয়া হয় ওর সঙ্গে। আমি যে-সিরিযের কথা বলেছি একটু আগে, সেটা বানাচ্ছিল ওই প্রতিষ্ঠান। প্রথম পরিচয়ের পরই যখন-তখন যোগাযোগ করতে লাগলাম হোথর্নের সঙ্গে, এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। ওসব কাজ টেলিফোনেই সেরে নেয়া যেত।
মনে আছে, প্রথমবার যখন দেখি হোথর্নকে, তখন ওই প্রোডাকশন অফিসের রিসিপশন এরিয়ায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিল সে, রেইনকোটটা খুলে ভাঁজ করে রেখেছিল কোলের উপর। ওকে দেখামাত্র বুঝতে পারি, ওর সঙ্গেই দেখা করার কথা আমার।
সে বিশালদেহী কেউ না। এবং প্রথম দেখায় মোটেও ভয়ঙ্কর বলে মনে হয় না ওকে। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র যেভাবে দাঁড়িয়ে গেল, সে-ভঙ্গি দেখে কোনো প্যান্থার বা চিতাবাঘের কথা মনে পড়ে গেল আমার। অত মসৃণ আর ক্ষিপ্র গতিতে কোনো মানুষকে কখনও উঠে দাঁড়াতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিদ্বেষ বা অপচিকীর্ষায় যেন জ্বলজ্বল করছে ওর হালকা বাদামি দুই চোখ। মনে হলো, আমাকে যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে সে, যেন হুমকি দিচ্ছে নিঃশব্দে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। খুবই ছোট করে কাটিয়ে-রাখা চুলের রঙ ঠাহর করা যায় না চট করে। ওগুলো ওর দুই-কানের কাছে ধূসর হতে শুরু করেছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রঙ পাণ্ডুর। কল্পনা করে নিলাম, যখন ছোট ছিল সে, তখন সুন্দর ছিল; কিন্তু তারপর ওর জীবনে এমন কিছু-একটা ঘটেছে, যার ফলে কুৎসিত-না- হওয়ার পরও আকর্ষণীয়-বলতে-যা-কিছু ছিল ওর চেহারায় সব বিদায় নিয়েছে। ব্যাপারটা যেন এ-রকম: সে নিজেই পরিণত হয়েছে নিজের বাজে একটা ফটোগ্রাফে।
স্যুট, সাদা শার্ট আর টাই পরেছে সে; স্মার্ট দেখাচ্ছে ওকে। উঠে দাঁড়ানোয় রেইনকোটটা এখন ভাঁজ করা অবস্থায় আছে এক হাতের উপর। তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আরও বেশি জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে চোখ দুটো… যেন কৌতূহল অতি-মাত্রায় পেয়ে বসেছে ওকে… আমি যেন চমকে দিয়েছি ওকে।
‘হ্যালো, অ্যান্টনি,’ বলল সে, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল।’
আমি কে, সেটা সে জানল কী করে? অফিসে অনেকেই আসছে এবং যাচ্ছে, কেউই আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেনি, আমার নাম উচ্চারণ করেনি। আমিও ওকে কিছু বলিনি।
তা হলে?
‘আমি আপনার লেখালেখির একজন ভক্ত বলতে পারেন,’ বলছে হোথর্ন, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গি দেখেই বুঝলাম, আমার একটা লেখাও পড়েনি কখনও।
‘ধন্যবাদ, ভদ্রতা করলাম আমি। ‘আমিও আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি।’
‘মজা হবে তা হলে।’
কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, হোথর্নের সঙ্গে কাজ করে একটুও মজা পাইনি আমি।
আগেও বলেছি, টেলিফোনে ওর সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো আমার। ছয়-সাতবার দেখাও করেছি বিভিন্ন জায়গায়। কখনও কখনও ওই প্রোডাকশন কোম্পানির অফিসে, কখনও আবার জে অ্যান্ড এ’র বাইরে। (ধূমপানের বদভ্যাস আছে হোথর্নের, চেইনস্মোকার বলা যায় ওকে… ল্যাম্বার্ট অ্যান্ড বাটলার অথবা রিচমন্ডের মতো সস্তা সিগারেট খায় বেশিরভাগ সময়। )
জানতে পারলাম, এসেক্সে থাকে সে, কিন্তু সেটা ঠিক কোন্ জায়গায়, সে- ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পেলাম না। নিজের ব্যাপারে কখনোই কিছু বলত না সে। পুলিশফোর্সে থাকতে কী করত না-করত, সে-ব্যাপারেও কিছু বলত না কখনও। কেন হঠাৎ বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে, তা নিয়ে ভুলেও কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি কোনোদিন।
কিন্তু আমার কৌতূহল কি আর থেমে থাকে? তাই একদিন গিয়ে ধরলাম সেই প্রোডাকশন সুপারভাইযারকে।
জানা গেল, বেশ কয়েকটা হাই-প্রোফাইল মার্ডার ইনভেস্টিগেশনে কাজ করেছে হোথর্ন। এবং বেশ নামডাকও আছে ওর। গুগলে সার্চ দিলাম ওর নামটা, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না।
অসাধারণ একটা মন… বলা ভালো, কল্পনাশক্তির অধিকারী সে। লেখালেখির কোনো অভ্যাস নেই, কোনো পরিকল্পনাও নেই ওই ব্যাপারে। আমার সেই সিরিয নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। তারপরও, যখনই ওই সিরিযের চিত্রনাট্যের কোনো একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতাম ওর সঙ্গে, ঘটনার শেষটা বলে দিত সে, এবং আশ্চর্য হয়ে টের পেতাম, ঠিক সে-রকম কিছু-একটাই ভেবে রেখেছিলাম আমি। আবারও একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে ব্যাপারটা। ওই চিত্রনাট্যের একজায়গায় ছিল, আমার সেই গোয়েন্দাচরিত্র, কৃষ্ণাঙ্গ একটা ছেলেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে পুলিশের হাত থেকে। পুলিশ ওই ছেলের বিরুদ্ধে একটা মেডেল চুরির অভিযোগ এনেছে। বলা হচ্ছে, মেডেলটা নাকি পাওয়া গেছে ওই ছেলের জ্যাকেটের পকেটে। কিন্তু সে-মেডেল হাতে নিয়ে দেখা গেল, সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে সেটা। তারপর পরীক্ষা করা হলো ওই ছেলের জ্যাকেটের পকেট, কিন্তু সালফেইমিক অ্যাসিড অথবা অ্যামোনিয়ার কোনো নমুনা পাওয়া গেল না– ওগুলোই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় রূপার জিনিসপত্র পরিষ্কার করার কাজে। তার মানে প্রমাণিত হয়ে গেল, ছেলেটার জ্যাকেটের পকেটে ওই মেডেল থাকতে পারে না। অর্থাৎ, ওটা চুরি করেনি সে।
বলা বাহুল্য, এই আইডিয়াও ছিল হোথর্নের
আমাকে যে পদে-পদে সাহায্য করেছে সে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই আমার। তারপরও ওর সঙ্গে যতবার যোগাযোগ করেছি, যতবার দেখা করেছি, অদ্ভুত এক শঙ্কা ততবার কাজ করেছে আমার মনে। অকাজের কথা একটাও বলতে রাজি না সে… যতবার কথা হয়েছে ওর সঙ্গে প্রায় ততবারই সরাসরি চলে গেছে মূল প্রসঙ্গে। ভাবখানা এমন, দুনিয়ার কোনো কিছু নিয়েই কোনো আগ্রহ নেই ওর। লোকে এটা-সেটা নিয়ে কত কথা বলে… আবহাওয়া অথবা সরকার থেকে শুরু করে ফুকুশিমার সাম্প্রতিক ভূমিকম্প অথবা প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ে; কিন্তু হাতে যে-কাজ আছে সেটা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কখনও একটা কথাও বলতে শুনিনি হোথৰ্নকে।