একদিন হুট করে বেজে উঠল আমার মোবাইল।
স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি, নম্বরটা অপরিচিত। ভাবলাম, জ্যাকসন বা স্পিলবার্গ কেউ ফোন করেছেন নাকি? সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। তাঁদের কেউ সরাসরি ফোন করবেন না আমাকে। তাঁদের কোনো অ্যাসিস্টেন্ট হয়তো করতে পারে… লাইনে আমি আছি কি না সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর ফোন দিতে পারে তাঁদের কাউকে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল দশটা। নিজের ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে, অফিসরুমে বসে আছি; রেবেকা ওয়েস্টের লেখা দ্য মিনিং অভ ট্রিযন বইটা পড়ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনের উপর লেখা ওই উপন্যাস একটা ক্লাসিক। বইটা বন্ধ করে তুলে নিলাম মোবাইল ফোন।
‘টনি?’ একটা কণ্ঠ জানতে চাইল।
নিশ্চিত হয়ে গেলাম, স্পিলবার্গ অথবা তাঁর কোনো সহকারী ফোন করেনি। কারণ খুব কম লোকই আমাকে টনি নামে ডাকে। সত্যি বলতে কী, নামটা পছন্দ করি না আমি। আমার আসল নাম অ্যান্টনি। বন্ধুরা কেউ কেউ বলে, অ্যান্ট।
‘হ্যাঁ, বলছি,’ বললাম আমি।
কেমন আছেন, মেইট? আমি হোথর্ন।’
সে ওর নামটা বলার আগেই ওকে চিনতে পেরেছি। স্বরবর্ণের নীরস উচ্চারণ, কথার সেই অদ্ভুত টান– কিছুটা লন্ডনবাসীদের মতো, আবার কিছুটা উত্তরাঞ্চলের মানুষদের মতো… এবং সবচেয়ে বড় কথা সেই ‘মেইট’ শব্দটা। হোথর্ন ছাড়া আর কারও ট্রেডমার্ক না এসব।
‘মিস্টার হোথর্ন,’ বললাম আমি, ‘আপনার ফোন পেয়ে ভালো লাগছে।’
আমাদের যখন পরিচয় হয়েছিল, তখন জানতে পেরেছিলাম, ওর নামের প্রথম অংশটা ড্যানিয়েল। কিন্তু ওই নাম ব্যবহার করতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে আমার। সে নিজেও তেমন একটা ব্যবহার করে না নামটা। অন্য কাউকেও ওটা ব্যবহার করতে শুনিনি কখনও।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হোথর্নের কণ্ঠ অধৈর্য। ‘সময় আছে আপনার হাতে?’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘আপনার সঙ্গে দেখা করা যায় কি না ভাবছিলাম। আজ বিকেলে কী করছেন?’ এ-রকম কথাবার্তাও হোথর্নের ট্রেডমার্ক। আগামীকাল অথবা আগামী সপ্তাহে দেখা করতে পারবো কি না ওর সঙ্গে, সেটা জিজ্ঞেস করছে না সে; বরং যেইমাত্র আমাকে প্রয়োজন হয়েছে ওর, সঙ্গে সঙ্গে সে-প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে এখনই করতে হবে আমাকে, এবং সেটা ওর প্রয়োজন অনুযায়ীই।
একটু আগেই বলেছি, সেদিন তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ ছিল না আমার হাতে, কিন্তু সেটা হোথর্নকে বলতে যাবো কেন? তাই বললাম, ‘আসলে… আমি ঠিক নিশ্চিত না…
‘যে-ক্যাফেতে দেখাসাক্ষাৎ করতাম আমরা একসময়, আজ বিকেল তিনটার সময় সেখানে আসতে পারবেন?’
‘জে অ্যান্ড এ?’
‘হ্যাঁ। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে আমার। যদি সময় দিতে পারেন, খুব ভালো হয়… কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার প্রতি।
জে অ্যান্ড এ ক্যাফেটা ক্লার্কেনওয়েলে… আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। অনুরোধটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো যুৎসই কোনো অজুহাতও মনে পড়ল না চট করে। তা ছাড়া… সত্যি বলতে কী… প্ৰচ্ছন্ন একটা আগ্রহ বোধ করতে শুরু করেছি হঠাৎ করেই।
‘ঠিক আছে,’ বললাম আমি, ‘তিনটার সময় দেখা হবে।’
‘খুব ভালো, মেইট। দেখা হবে।’
লাইন কেটে দিল হোৰ্থন।
আমার সামনে কম্পিউটারের স্ক্রীনে টিনটিনের চিত্রনাট্য। ওটা বন্ধ করে দিলাম আমি। হোথর্নকে নিয়ে ভাবছি।
ইনজাস্টিস নামের একটা পাঁচ-পর্বের টেলিভিশন সিরিযের জন্য একবার কাজ করছিলাম আমি, সে ঘটনার আগের বছর হোথর্নের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। ওই সিরিযে একটা গোয়েন্দা চরিত্র ছিল, তাকে হোথর্নের আদলে তৈরি করি আমি– ভয়ঙ্কর, বর্ণবাদী, রগচটা এবং আক্রমণাত্মক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, হোথর্ন মোটেও সে-রকম কেউ না। অন্ততপক্ষে বর্ণবাদী তো না-ই। তবে আমার কাছে সব সময়ই বিরক্তিকর মনে হয়েছে ওকে। মনে হয়েছে, আমি যে-রকম, সে ঠিক তার উল্টো।
ওই সিরিযে প্রোডাকশন সুপারভাইযারের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনিই হোথর্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমাকে। তখন জানতে পারি, হোর্থন হচ্ছে লন্ডনের মেট্রোপলিটান পুলিশ সার্ভিসের একজন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর, পাটনি’র সাব কমান্ডের বাইরে আছে আপাতত। হোমিসাইড স্পেশালিস্ট বলতে যা বোঝায়, সে ঠিক তা-ই। দশ বছর ধরে কাজ করছিল পুলিশফোর্সে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে… কারণটা ঠিক জানা নেই আমার।
যা-হোক, অপরাধ জগৎ নিয়ে লেখালেখি করতে হলে অথবা সিনেমা-নাটক বানাতে গেলে পুলিশের-এককালের-অফিসারদের সঙ্গে কমবেশি খাতির রাখতে হয়। কারণ তাঁরা এমন সব তথ্য দিতে পারেন, যেগুলো গল্প-উপন্যাসে অথবা নাটক-সিনেমায় যোগ করা হলে কাহিনিটা সত্যি বলে মনে হয়। আর হোথর্ন ছিল ওই কাজে ঝানু। আমি কী চাই, তা চট করে বুঝে ফেলার সহজাত একটা প্রবৃত্তি ছিল ওর ভিতরে। একটা উদাহরণ দিই। একবার এক কাহিনিতে আমার কল্পনার গোয়েন্দাচরিত্র এক সপ্তাহের পুরনো একটা লাশ দেখতে যায়। তাকে তখন নাকের নিচে মাখার জন্য ভিক্স-ভ্যাপোরাব দেয় ক্রাইম সিন একযামিনার। এক সপ্তাহ ধরে পচেছে লাশ, কাজেই বিকট গন্ধ বের হতে থাকবে ওটা থেকে, সুতরাং নাকের নিচে যদি ওই মেনথোলেটাম লাগিয়ে নেয় আমার গোয়েন্দা, তা হলে সেটা ভালো হবে ওর জন্য– মলমের গন্ধের নিচে চাপা পড়ে যাবে পচা-লাশের দুর্গন্ধ। বলা বাহুল্য, বুদ্ধিটা আমার না, হোথর্নের।