খোঁজখবর করতে শুরু করে পুলিশ। এবং মিসেস ক্যুপার যে সেদিনই কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স-এ গিয়েছিলেন, সেটা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যায়। বুঝতে পারে, জটিল একটা ধাঁধার সম্মুখীন হয়েছে তারা।
ব্যাপারটা ভাববার মতো। নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে সেদিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঘটনা বিরল… ও-রকম কোনো নজির নেই বললেই চলে। কাজেই পুলিশ অনুমান করে নেয়, পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয় না। মিসেস ক্যুপারের সেই-ফিউনারেল-পার্লারে যাওয়া এবং ঘণ্টা ছয়েক পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মধ্যে কোনো-না-কোনো যোগসূত্র আছে। তাঁকে যে খুন করা হবে, সেটা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন তিনি? কেউ কি তাঁকে সেই ফিউনারেল পার্লারে ঢুকতে এবং সেখান থেকে বের হতে দেখেছে? তারপর সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর উপর? তিনি যে ওই পার্লারে গিয়েছিলেন, কে কে জানত সেটা?
ব্যাপারটা আসলেই রহস্যজনক। এবং সে-রহস্য ভেদ করার জন্য একজন স্পেশালিস্ট প্রয়োজন। তবে যে-সময়ের কথা বলছি তখন ওই ব্যাপারে তেমন কিছু করার ছিল না আমার।
কিন্তু ঘটনা বদলে যেতে বেশি সময় লাগল না।
২. হোথর্ন
যেদিন সন্ধ্যায় খুন হলেন ডায়ানা ক্যুপার, সেদিনের কথা মনে করতে কোনো কষ্ট হয় না আমার। আমি তখন এক্সমাউথ মার্কেটে ‘মোরো’ নামের একটা রেস্টুরেন্টে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ডিনার করছি। সেদিন বিকেলেই আমার প্রকাশকের কাছে ই- মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম নতুন উপন্যাসটা। ওটা লিখতে টানা আট মাস খাটুনি করতে হয়েছিল আমাকে।
উপন্যাসটার নাম দ্য হাউস অভ সিল্ক। এ-উপন্যাসে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে শার্লক হোমসকে। আমি কখনও ভাবিনি, কিংবদন্তির গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে কিছু লিখবো। আমার কাছে একদিন হঠাৎ করেই হাজির হলেন কোনান ডয়েল এস্টেটের কয়েকজন কর্মকর্তা। হোমসের নতুন কোনো উপন্যাস লেখার দায়িত্ব দিতে চাইছিলেন তাঁরা কাউকে। সুযোগ পাওয়ামাত্র যেন ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। আমার বয়স যখন সতেরো, হোমসের কাহিনিগুলো পড়েছিলাম তখন। তারপর থেকে, সারাটা জীবন ধরে, ওই গল্পগুলো রয়ে গেছে আমার সঙ্গে। আমি মনে করি, হোমস, সমস্ত আধুনিক গোয়েন্দা চরিত্রের বাবা। কিন্তু শুধু সে-কারণেই ওকে ভালোবাসিনি আমি। ওর প্রতিটা কাহিনিই দুর্দান্ত ছিল… কিন্তু সেটাও ওই চরিত্রকে ভালোবাসার একমাত্র কারণ না। আসলে হোমস আর ওয়াটসনের সেই জগত্টা… সে-সময়ের থেমস নদীর ধারের লন্ডনটা– খোয়াবিছানো পথের উপর দিয়ে ঘর্ঘর শব্দে ছুটে-চলা চারচাকার সেই হ্যাঁনসাম ক্যাব, সেই গ্যাসল্যাম্প, আর পাক খেয়ে- খেয়ে ভাসতে-থাকা সেই কুয়াশা… সব কিছু যেন অমোঘ একটা আকর্ষণ জাগিয়ে তুলেছিল আমার মনে। ওসব যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল আমাকে… ২২১বি বেকার স্ট্রীটে হাজির হয়ে সাহিত্য-ইতিহাসের সবচেয়ে-বড়-বন্ধুত্বটা প্রত্যক্ষ করার। সে- নিমন্ত্রণ কী করে প্রত্যাখ্যান করি?
আমার দায়িত্ব ছিল, উপন্যাসের শুরুতেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলা– কোনান ডয়েলের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। তাঁর যেসব সাহিত্যিক-ঢং ছিল, সোজা কথায়, সেগুলো অনুকরণ করা। এবং অনুপ্রবেশকারীদের মতো নিজস্ব কোনো কায়দায় কোনো বর্ণনা জুড়ে না-দেয়া। ওই উপন্যাসের প্রতিটা লাইন লেখার সময় ভেবেছি, কোনান ডয়েল নিজে যদি লিখতেন সেটা, তা হলে কীভাবে লিখতেন? মোদ্দা কথা, স্থান-কাল-পাত্র এবং ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে দেয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে আমার কোনো ছাপই যাতে না-থাকে ওই উপন্যাসে।
যে-সময়ের কথা বলছি, তখন আমি একজন কিশোর-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। এবং, সত্যি বলতে কী, মনে মনে আশা করছিলাম, দ্য হাউস অভ সিল্কউপন্যাসটা আমার সে-পরিচয় পাল্টে দেবে। কেন একজন কিশোর-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলাম, তা-ও একটু বলি। অ্যালেক্স রাইডার নামের টিনএজার এক গুপ্তচরকে নিয়ে ২০০০ সালে একটা সিরিয লিখতে শুরু করি আমি। ওই সিরিযের জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করে একসময়, সারা বিশ্বব্যাপী বিক্রি হতে শুরু করে বইগুলো। শিশু-কিশোরদের জন্য বই লিখছিলাম ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও টের পাচ্ছিলাম, আসলে যা লিখতে চাই আমি, সেটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। ওদিকে বয়সও থেমে নেই… পঞ্চান্নতে পা দিয়ে ফেলেছি। কাজেই অন্য কোনো দিকে সরে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করছিলাম আসলে। মনে আছে, তখন একটা সাহিত্য-উৎসবে অ্যালেক্স রাইডার সিরিযের দশম বই স্করপিয়া রাইযিং নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল আমার।
আরও একটা কাজ ছিল আমার হাতে তখন। ‘টিনটিন টু’ নামের একটা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সম্পাদনা করার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল আমাকে। এবং কাজটা করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ স্বয়ং। সিনেমাটা পরিচালনা করার কথা ছিল পিটার জ্যাকসনের। তখন আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না, চিত্রজগতের সবচেয়ে বড় দু’জন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছি। কীভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা, সে-ব্যাপারে আজও আমি নিশ্চিত না।
অস্বীকার করে লাভ নেই, বেশ নার্ভাস ছিলাম তখন। ওই চিত্রনাট্য কম-করে- হলেও বারোবার পড়ে ফেলেছি, নিজের সেরাটা ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করছি ওই কাজে। বার বার ভাবছি, চরিত্রগুলো কি ঠিকমতো বর্ণনা করা হয়েছে? ঘটনার ধারাবাহিকতা কি ঠিকমতো সাজানো হয়েছে? যে-সময়ের কথা বলছি, তখন সপ্তাহখানেকের মধ্যে লন্ডনে একসঙ্গে হাজির হওয়ার কথা জ্যাকসন আর স্পিলবার্গের। তাঁদের সঙ্গে দেখা করার কথা আমার, তাঁদের শলাপরামর্শ নেয়ার কথা।