ঠিক কখন সেই ফিউনারেল পার্লারে ঢুকেছিলেন মিসেস ক্যুপার, সেটা জানা গেছে; কারণ দুটো সিসিটিভি’র রেকর্ডে দেখা গেছে তাঁকে… একটা রাস্তার, অন্যটা যে-বাসে সওয়ার হয়ে সেদিন সকালে বাসা থেকে ফুলহ্যাম রোডে গিয়েছিলেন তিনি, সে-বাসের। অদ্ভুত একটা খেয়াল ছিল তাঁর… সব সময় গণপরিবহন ব্যবহার করতেন। অথচ শোফার-সহ একটা গাড়ির ব্যবস্থা করাটা কোনো ব্যাপারই ছিল না তাঁর জন্য।
বারোটা বাজার মিনিট পনেরো আগে ফিউনারেল পার্লার থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে এগোন সাউথ কেনসিংটন টিউব স্টেশনের দিকে। সেখানে গিয়ে সওয়ার হন পিকাডিলি লাইনে, পৌঁছে যান গ্রীন পার্কে। সেইন্ট জেমস’স স্ট্রীটের ‘ক্যাফে-মুরানো’ নামের একটা দামি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নেন এক বন্ধুর সঙ্গে। ওই রেস্তোরাঁ, ফোর্টনাম অ্যান্ড মেসন-এর কাছে অবস্থিত। যা-হোক, খাওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়ে আসেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েন সেটাতে, সোজা গিয়ে হাজির হন গ্লোব থিয়েটারে। তবে কোনো মঞ্চনাটক দেখার জন্য যাননি সেখানে। তিনি ছিলেন ওই থিয়েটারের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য, সেদিন অংশ নিয়েছিলেন বিল্ডিঙের একতলায় অনুষ্ঠিত একটা মিটিঙে, দুপুর দুটোর সময় শুরু হয়ে বিকেল পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ আগপর্যন্ত চলেছিল সে-মিটিং। ছ’টা বাজার পাঁচ মিনিট পর বাসায় পৌঁছান। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, তবে তাঁর সঙ্গে একটা ছাতা ছিল, বাসায় ঢোকার আগে সদর-দরজার কাছে একটা ভিক্টোরিয়ান স্ট্যান্ডের ভিতরে রাখেন ওটা।
ত্রিশ মিনিট পর কেউ একজন তাঁর গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তাঁকে।
চেলসি’র ঠিক পরই, ব্রিটানিয়া রোডের টেরেসওয়ালা সুন্দর-একটা-বাড়িতে থাকতেন তিনি। রাস্তায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, কাজেই খুনটা যখন হয়েছে তখন কে ওই বাড়িতে ঢুকেছে অথবা বেরিয়ে গেছে, সেটা জানারও কোনো উপায় ছিল না। আশপাশের বাড়িগুলোও ছিল জনশূন্য। প্রতিবেশী ওই বাড়িগুলোর একটার মালিক দুবাইভিত্তিক একটা কনসোর্টিয়াম। সে-বাড়িতে থাকার প্রশ্নই আসে না মালিকপক্ষের, তাই সেটা ভাড়া দেয়া হয়েছিল। তবে মিসেস ক্যুপারকে যখন খুন করা হয়, তখন কোনো ভাড়াটে ছিল না ওই বাড়িতে। প্রতিবেশী অন্য একটা বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত এক উকিল এবং তাঁর স্ত্রী। খুনটা যখন হয়েছে তখন তাঁরা দক্ষিণ ফ্রান্সে অবকাশ যাপন করছেন।
সুতরাং মিসেস ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে রহস্যজনক কোনো কিছু শুনতে পায়নি কেউ।
টানা দু’দিন লাপাত্তা ছিলেন তিনি… মানে, ওই দু’দিন কেউ দেখেনি তাঁকে, তাঁকে নিয়ে কিছু শোনেওনি। তাঁর বাড়িতে কাজ করত আন্দ্রিয়া ক্লুভানেক নামের এক স্লোভাকিয়ান ক্লিনার, সপ্তাহে দু’দিন যেত সেখানে, এক বুধবার সকালে খুঁজে পায় সে লাশটা।
লিভিংরুমের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন ডায়ানা ক্যুপার। পর্দা বাঁধার কাজে যে-রকম দড়ি ব্যবহৃত হয়, সে-রকম একটা লাল রঙের দড়ি পেঁচানো অবস্থায় ছিল তাঁর গলায়। ফরেনযিক রিপোর্ট বলছে, খুনি এত জোরে টান দিয়েছিল ওই দড়িতে যে, মিসেস ক্যুপারের গলার হায়োয়িড বোন ভেঙে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দুই চোখের কনজাঙ্কটাইভা।
দৃশ্যটা আন্দ্রিয়ার জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। বছর দু’-এক ধরে ওই বাড়িতে কাজ করছিল সে, বেশ পছন্দ করত মিসেস ক্যুপারকে। কারণ তার সঙ্গে শুধু ভালো ব্যবহারই করতেন না তিনি, বরং কখনও কখনও তাকে কাজ শেষে ডেকে নিয়ে দু’জনে একসঙ্গে কফিও খেতেন। যা-হোক, আন্দ্রিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, ফিকে লাল রঙ ধারণ করেছিল মিসেস ক্যুপারের চেহারা। বিস্ফারিত দুই চোখে তাকিয়ে ছিলেন তিনি নিষ্পলক-নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে। মুখের বাইরে বীভৎস ভঙ্গিতে বেরিয়ে পড়েছে জিভটা… দৈর্ঘ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। যেন কিছু-একটা আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিতে সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল একটা হাত, অভিযোগ করার ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে সে-হাতের একটা আঙুল। হীরার একটা আংটি ওই আঙুলে। বাসার ভিতরে তখন সেন্ট্রাল হিটিং চলছে, পচতে শুরু করেছে লাশ, দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
পুলিশের কাছে যে-বিবৃতি দিয়েছে আন্দ্রিয়া, সে-অনুযায়ী, তখন চিৎকার করেনি সে। অসুস্থও হয়ে পড়েনি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, তারপর নিজের মোবাইল ফোন থেকে কল দেয় পুলিশের নম্বরে। পুলিশ না- পৌঁছানো পর্যন্ত আর ঢোকেনি ওই বাড়ির ভিতরে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর পুলিশ অনুমান করে নেয়, চৌর্যবৃত্তির শিকার হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার। তাঁর কিছু গহনা আর একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার খোয়া গেছে। কিছু-একটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে সারা বাড়ির বেশিরভাগ ঘরে, এবং যেসব ঘরে খোঁজ চালানো হয়েছে সেগুলো তছনছ করে ফেলা হয়েছে। তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ফলে ধারণা করে নেয়া যেতে পারে, কেউ একজন জোরপূর্বক ঢুকেছে ওই বাড়িতে। যে-লোক হামলা চালিয়েছে মিসেস ক্যুপারের উপর, স্পষ্ট বোঝা গেছে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সে-লোকের জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন তিনি। তবে লোকটাকে তিনি চিনতেন কি না, বোঝা যায়নি। তবে এটা বোঝা গেছে, ওই দড়ি ব্যবহার করে হঠাৎ করেই পেছন থেকে ফাঁস লাগানো হয়েছিল তাঁর গলায়, এবং ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে কোনো বাধাই দিতে পারেননি হামলাকারীকে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে, ডিএনএ অথবা অন্য কোনো জাতের ক্লু-ও পাওয়া যায়নি। তার মানে অনুমান করে নেয়া যেতে পারে, ভালোমতো ছক কষেই হাজির হয়েছিল খুনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছিল সে মিসেস ক্যুপারকে। বাড়ির লিভিংরুমে ভেলভেটের পর্দা আছে, আর সেগুলোর পাশে আছে হুক; ওই হুক থেকেই খুলে নিয়েছিল সে লাল-রঙের দড়িটা। তারপর চুপিসারে হাজির হয়ে যায় মিসেস ক্যুপারের পেছনে, হঠাৎ করেই ফাঁস লাগিয়ে দেয় তাঁর গলায়, এরপর সজোরে টেনে ধরে দড়ির দুই প্রান্ত। মারা পড়তে মিনিটখানেকের বেশি লাগেনি মিসেস ক্যুপারের।